মানুষের প্রতিটা কাজের মাঝেই একটা আর্ট আছে। সেই আর্টের উনিশবিশের কারণেই কাজের সৌন্দর্যগুন বাড়ে বা কমে।

ছোটবেলায় টেবিল ম্যানার্স শেখানোর সময় আমাদের বলা হয়েছিল খাবার মাখার সময় আংগুলের এক করা দাগের বাইরে খাবার যেনো না যায়। প্লেটের একটা নির্দিষ্ট গণ্ডির বাইরে খাবার মাখা যাবে না। খাবার সময় মুখের এবং চামচের কোনো সাউন্ড হবে না। এঁটো হাতে কোনো জিনিস ধরা যাবে না। পানি খাওয়ার সময় ঢকঢক আওয়াজ করা যাবে না। চা পান করার সময় সুরুত সুরুত করে আওয়াজ করা যাবে না। প্লেটে হাত ধোয়া যাবে না, দাত খুঁচানো যাবে না, মুখে আঙুল ঢুকানো যাবে না, জিহ্বা বের করে খাওয়া যাবে না, খাওয়ার সময় মুখে খাবার নিয়ে উচ্চস্বরে কথা বলা বা হাসা যাবে না, থু করে মুখ থেকে এখানে সেখানে কিছু ফেলা যাবে না, ইত্যাদি হাজারটা নিয়ম শিখতে হয়েছিল। আলহামদুলিল্লাহ্‌ নিজের বাচ্চাদেরকেও এসব শেখানোর চেষ্টা করেছি। এসব না মানা মানে আমাদের কাছে ব্যাড ম্যানার্স।

চামচ বা প্লেট ধরার স্টাইল বা খাবার সার্ভ করার ম্যানার্স, কোন প্লেটে কোন খাবার সার্ভ করা, কোন চামচ দিয়ে কি সার্ভ করতে হবে, এমনকি শুধু এক গ্লাস পানি দেওয়ার সময় পানির গ্লাসের নিচে যে ছোট প্লেট বা পিরিচ বা ট্রে তে আনতে হয় এসব খুঁটিনাটি জিনিস আমাদের শেখানো হয়েছিল।

আমাদের ছোটবেলায় দেখেছি এসব ম্যানার্স তখন মধ্যবিত্ত বা উচ্চবিত্তরা ভালোই মেনে চলতো। ক্ষেত্রবিশেষে নিম্নবিত্তরাও মেনে চলতো। কিন্তু এখন মানুষের অনেক টাকাপয়সা, বড় চাকরি করে, দামি জামাকাপড় গায়ে, রেস্টুরেন্টে গিয়ে খায়, কি মধ্যবিত্ত বা কি উচ্চবিত্ত, কোনো টেবিল ম্যানার্সই জানে না।

কোট টাই গায়ে, চকচকে জুতা পায়ে দেয়া একজন উচ্চপদস্থ কোনো লোক যদি খাওয়ার সময় কাটা ফেলার প্লেটে কাটা না ফেলে টেবিলে কাটা ফেলে, কুলি কুচি করে গলা খাকরে পানি খেয়ে হাতটা খাবার প্লেটে ধুয়ে ফেলে তখন ইচ্ছে হয় কানে ধরে ট্যাবিল ম্যানার্স শিখিয়ে দেই।

আমি যখন স্কুলে বাচ্চাদের পড়াতাম, তখন বেশ কিছুদিন প্লে-গ্রুপের ক্লাস টিচার ছিলাম। দুনিয়াতে বাচ্চাদের মানুষ করা সবচেয়ে কঠিন কাজ। কি সে নিজের বাচ্চা হোক বা অন্যের বাচ্চা হোক। সেই সময় একটা ছোট্ট বাচ্চা, প্লে-গ্রুপের বাচ্চা আর কত বড় হবে, খুব বেশী হলে ৪ বছর হবে। সে যখন টিফিন টাইমে টিফিন খেতো আমি অবাক হতাম। তার মা'কে স্যালুট দিতে ইচ্ছে করতো। টিফিনের সময় শান্ত হয়ে বাচ্চাটা ব্যাগ থেকে একটা লাল সাদা চেক ন্যাপকিন টেবিলে বিছাতো। এরপর টিফিন বক্স আর ফ্লাক্সটা সেই ন্যাপকিনের উপর রাখতো। এরপর বক্স খুলে রুটি ছিড়ে আলু ভাজি দিয়ে রুটি মুখে দেওয়ার সময় জোড়ে বলতো 'বিসমিল্লাহ্‌'। বেশিরভাগ দিন সে আলু ভাজি আর রুটি নিয়ে আসতো।

আরেকটা ঘটনা বলি আমাদের ছুটা বুয়ার। সে বাসা থেকে ভাত নিয়ে আসে। তার ভাত তরকারী সে খুব সুন্দর করে গুছিয়ে টিফিন বক্সে আনে। খাওয়ার সময় পানির গ্লাস নিয়ে বসে, কাটা ময়লা সে কখনো ফ্লোরে ফেলে না। তার খাওয়া, বসার স্টাইল সব গুছানো এবং রুচিসম্মত। এটা না দেখলে বুঝানো যাবে না।

এই যে বাচ্চাটা বা বুয়ার কথা বললাম, এরা কিন্তু এসব পরিবার থেকেই শিখে এসেছে। মানুষের এসব আচার আচরণ দেখলে বুঝা যায় তার পরিবার কেমন, তার বেড়ে উঠা কেমন পরিবেশে হয়েছে।

এমনকি ধর্মীয় ভাবেও এসব ম্যানার্স মানার কথা আছে। পানি কিভাবে খেতে হবে, খাবার নেওয়ার সময় কিভাবে খাবার নিতে হবে, খুব গরম খাবার মুখে দেওয়া যাবে না, এমন খুঁটিনাটি জিনিস রাসুলুল্লাহ সাল্লাললাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম আমাদের শিখিয়ে দিয়ে গিয়েছেন।

কিছু মানুষের আচরণ দেখলে মনে হয়, এসব ম্যানার্স না মানাটাই বুঝি খুব বড় ক্রেডিট। জ্বী না, সেটা বড় ডিসক্রেডিট।

এখন আসুন জেনে নেই রাসুলুল্লাহ সাল্লাললাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম কিভাবে ম্যানার্স গুলো মেনে চলতেন এবং অন্যদেরকেও সেসব মেনে চলতে বলতেন।

  • খাবার খাওয়ার আগে জেনে নেওয়া যে, খাবার কোথা থেকে এসেছে এবং সেটা কি ধরনের খাবার।
  • বিসমিল্লাহ বলে খাওয়া শুরু করা।
  • ডান হাতে খাওয়া।
  • পুরো প্লেট ঘাটাঘাটি না করে, প্লেটের সামনে যা আছে সেখান থেকে খাবার নেওয়া।
  • খাওয়ার পরে হাতের আংগুল চেটে খাওয়া, প্লেট মুছে খাওয়া এবং হাত ধোঁয়া।
  • যিনি দাওয়াত দিয়ে খাওয়ান, তার জন্য দু'আ করা।
  • খাবার নীচে পড়ে গেলে সেটা পরিষ্কার করে খেয়ে ফেলা।
  • খাওয়া শেষে আলহামদুলিল্লাহ বলা।
  • খাবারের সমালোচনা না করা। ভালো লাগলে খাবে, না ভালো লাগলে খাবে না।
  • হালাল খাবার খাওয়া, হারাম খাবার না খাওয়া।
  • পুরো পেট ভরে না খাওয়া, পেটের তিন ভাগের এক ভাগ পানি, এক ভাগ খাবার আর এক ভাগ খালি রাখা।
  • সোনা ও রূপার থালাবাসন, গ্লাস, চামচ ব্যবহার না করা।
  • খাওয়ার সময় হেলান না দিয়ে খাওয়া।
  • প্রচন্ড গরম খাবার না খাওয়া। খাবারে বা যে কোনো পানীয়তে ফুঁ না দেওয়া।
  • পানি খাওয়ার সময় তিন নিঃশ্বাসে পানি খাওয়া। নিঃশ্বাস গ্লাসে না ফেলা।
  • বোতলে বা জগে মুখ লাগিয়ে পানি পান না করা।
  • পানি বা অন্যান্য পানীয় পান করার পর অন্যজনকে দিতে হলে ডান পাশের জনকে আগে দেওয়া।

খেয়াল করলে দেখবেন যে উনার প্রতিটি কাজের বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা আছে। বিজ্ঞানীরা আজ এসব নিয়ে গবেষণা করছেন এবং এসব ম্যানার্স পালনের ফলে মানুষের শারীরিক সুস্থতা যে বজায় থাকে সেটা গবেষকেরা বের করছেন। তবে মুমিন ব্যক্তি গবেষকদের গবেষণার জন্য বসে থাকেন না, রাসুলুল্লাহ সাল্লাললাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম কে ভালোবেসেই এই ম্যানার্সগুলো মেনে চলেন।


#রৌদ্রময়ী_প্রবন্ধ, টেবিল ম্যানার্স, তাহনিয়া ইসলাম খান