[১]

একটা কথা এখন খুব শোনা যায়। ‘মানুষ অতিষ্ঠ। মানুষ পরিবর্তন চায়। কীভাবে পরিবর্তন আসবে?’ চাপা দুঃখ আর ক্ষোভ নিয়ে কেউ বলেন, ‘আর কতোদিন? এভাবেই কি আমাদের জীবনটা চলে যাবে?’ এই অনুভূতি, আবেগ ও জিজ্ঞাসার প্রতি শ্রদ্ধা রেখেই বলছি, এখানে কিছুটা ভুল বোঝাবুঝি আছে।

সত্যিকারভাবে আমরা এখনো আসলে পরিবর্তন চাই না। আমরা জাস্ট পরিবর্তনের আইডিয়াটা পছন্দ করি। তবে এটা বদলাবে। ব্যাখ্যা করছি।

দেখুন আমরা যখন পরিবর্তনের কথা বলি, তখন আসলে কী বোঝাই? পরিবর্তন আমরা কী বুঝি?

আমরা এমন পরিবর্তন চাই যেখানে আমার ব্যবসা, চাকরি, ঘর - আমার চারপাশের রাস্তাঘাট, স্কুল-কলেজ, আদালত-অ্যাডমিন্সট্রেইশান স-ব কিছু যেমন আছে তেমনই থাকবে, জাস্ট ওপর থেকে শাসক বা শাসন ব্যবস্থা বদলে যাবে। যুলুম বন্ধ হয়ে প্রতিষ্ঠিত হয়ে যাবে আদল-ইনসাফ।

আমরা ৫ বছর (কিংবা ১০ বছর) পর এক দিন ভোট দিয়ে সব পালটে ফেলবো। অথবা আমরা সবাই যখন নিজ শরীরে সুন্নাহ কায়েম করবো, কিংবা ফজরের জামাআতে যখন জুমুআহর মতো মুসল্লি হবে, কিংবা যখন আমাদের সবার আক্বিদা ১০০% সঠিক হয়ে যাবে তখন অটোম্যাটিক ইসলাম কায়েম হয়ে যাবে। ইসলামিস্ট বলেন আর সেক্যুলারিস্ট, আমাদের সবার চাওয়াটা অনেকটা এমনই। সব কিছু যেমন আছে তেমনই থাকবে শুধু আমার পছন্দের শাসক অথবা শাসন ব্যবস্থা চলে আসবে।

সমস্যা হল পৃথিবীর ইতিহাসে কোন পলিটিকাল সিস্টেমের পরিবর্তন এভাবে হয়নি, অদূর ভবিষ্যতে হবার সম্ভাবনাও নেই। অনেক দাম দিয়ে এই পরিবর্তনগুলো আনতে হয়। সময়, শ্রম, রক্ত, মানুষ – দু হাতে খরচ করে আনতে হয়। শাসকরা কখনও স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে শাসিতকে তাদের অধিকার দেয় না। তা ছিনিয়ে নিতে হয়।

সূরা আলাক্বের আয়াত নাযিল হওয়া থেকে শুরু করে মক্কা বিজয় পর্যন্ত সাহাবি রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুম ওয়া আজমাইন-দের কী কী করতে হয়েছে, কতো আত্মত্যাগ করতে হয়েছে একটু ভেবে দেখুন। নিজেদের পরিচিত লাইফস্টাইল, নিজের বন্ধু, নিজের সমাজ, নিজের পরিবার সব এক এক করে ছাড়তে হয়েছে। হতে হয়েছে নির্যাতিত, সামাজিকভাবে একঘরে। তারপর একসময় ছাড়তে হয়েছে নিজ জন্মভূমি। তবুও বিজয় হয়নি। যুদ্ধ করতে হয়েছে। নিজের গোত্র, নিজের আত্মীয়, নিজের বাবা-ভাই-সন্তানদের সাথে। তারপরও বিজয় আসেনি। অপেক্ষা করতে হয়েছে বদর, উহুদ, খন্দকসহ আরো অনেক দিন। আমরা কেন মনে করছি আমরা এগুলোর কোনটাই করবো না, কিন্তু একই ফলাফল পাবো?

একটু অন্যভাবে বলি। দেখুন একোনমিক্সে ইকুলিব্রিয়াম বলে একটা কনসেপ্ট আছে। সাম্যাবস্থা, ভারসাম্য। যখন ডিমান্ড ও সাপ্লাই সমান। ক্রেতা যতোটা চাচ্ছে, বিক্রেতা ততোটুকু দিতে পারছে। পণ্যের দাম স্থিতিশীল থাকছে। যদি ইকুলিব্রিয়াম পয়েন্টে থাকা অবস্থায় আপনি নতুন, আরো ভালো (কিংবা খারাপ) কোন ইকুলিব্রিয়াম পয়েন্টে যেতে চান, তাহলে এক পয়েন্ট থেকে আরেক পয়েন্টে যাবার সময়টুকু ইকুইলিব্রিয়ামের অনুপস্থিতিতে থাকবে। ভারসাম্যহীনতা, অস্থিতিশীলতা থাকবে। এটা হবেই। এটা প্রয়োজন।

এই ওভারসিমপ্লিফাইড কিন্তু ইউযফুল কনসেপ্টটা মানবসমাজ, রাষ্ট্র ও সভ্যতার ক্ষেত্রে প্রয়োগ করে দেখুন। এক সভ্যতা অথবা শাসনব্যবস্থা থেকে অন্য কোন বিন্দুতে যেতে হলে অবধারিতভাবেই অস্থিতিশীলতা এবং ভারসাম্যহীনতার একটা পর্যায় পার করতে হবে। ইতিহাস খুলে দেখুন। ৪৭, ৭১, সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন, ফরাসী বিল্পব, বলশেভিক বিপ্লব। যালুতের মৃত্যু, ফিরাউনের মৃত্যু, বনী ইস্রাইলের প্রথমবার বাইতিল মাকদিস বিজয়। সেক্যুলার ইতিহাস দেখুন, কিংবা ওয়াহির আলোতে দেখুন। এটা বিশ্বের অপরিবর্তনীয় নিয়মগুলোর একটা। আর কমনসেন্সও তাই বলে। ক্ষমতাসীন কি কখনো আপনার মুখের কথায়, নীতিবাক্য কিংবা কাগজের ব্যালটের টুকরোর ভয়ে তার ক্ষমতা ছেড়ে দেবে? নমরুদ দিয়েছে? ফিরআউন? আবু জাহল? ক্রুসেইডার? চেঙ্গিস খান? ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি? অ্যামেরিকা? ইস্রাইল? মোদি?

এতো সহজে কাঙ্ক্ষিত পরিবর্তন আসবে না। এতো সস্তায় পাওয়া যাবে না। আপনাকে, আমাকে – আমাদেরকে এই দাম কানায় কানায় মেটাতে হবে। তারপর। সব কিছু সব কিছুর মতো থাকবে, আমার জীবন আগের মতোই থাকবে, আমি মৌজমাস্তি করবো, আরামে জীবন কাটাবো আর দুম করে দিন বদলে যাবে – এমন চিন্তা করা বোকামি। দিন বদলাবে, তবে তার আগে আমাদের বদলাতে হবে। ইচ্ছায় কিংবা অনিচ্ছায়। হয় আমরা সঠিক পথ ও মতাদর্শ বেছে নেবো, অথবা আমরা এমন পরিস্থিতিতে পড়বো যেখানে আমরা বাধ্য হবো ‘অচিন্তনীয়’ কোন অপশান বেছে নিতে।

বাংলাদেশের মানুষ এখনো পরিবর্তন চায় না। আমরা এখনো অতিষ্ঠ হইনি। আমরা আছি ‘পরিবর্তন হলে ভালোই হয়’ এই অবস্থায়। পরিবর্তনের চিন্তাটা এখনো আমাদের কাছে ফোর্থ সাবজেক্ট কিংবা হবির মতো। এটা যতোক্ষণ ম্যান্ডেটরি না হচ্ছে, প্রায়োরিটি লিস্টের একদম ওপরে না আসছে ততোক্ষন দিন বদলাবে না। আমাদের সমাজ ও রাষ্ট্রের ক্ষেত্রে এ সত্যটা বোঝা জরুরী। আরো জরুরী হল আত্ম-অনুসন্ধানের সময় এ কথাগুলো মাথায় রাখা।

আপনি পরিবর্তন চান?
বেশ।
কিন্তু এর দাম দিতে রাজি তো?

[২]

চারদিকে হাহাকার। ভাবছি উম্মাহর এই দুর্যোগে আমার কী করা উচিত? অথবা, কেউ বলছি দুআ ছাড়া কিছু করার নেই। কেউ ঘরে বসে দোষারোপ করছি, আমাদের ভাইরা ঘরে বসে আছে কেন? কেন ওরা ময়দানে নামছে না?

কিন্তু কখনো কি হিসেব করেছি যে আমি; এই আমি আসলেই কী করলাম? খুব কম মানুষই কষ্ট স্বীকার করতে রাজি হয়। আমি আরামে থাকব, ব্যক্তিগত বিজনেসকে দ্বীনি খেদমত নাম দিব, সময়মতো খাওয়াদাওয়া, ঠিকমতো ঘুম সবই চলবে, কিন্তু সপ্তাহে একটা ঘন্টাও আল্লাহর রাস্তায় নিঃস্বার্থভাবে ব্যয় করব না, তারপর ভাবব দুআ ছাড়া কিছু করার নেই; হলো কিছু?

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, 'আদদুআউ সিলাহুল মুসলিম'—দুআ মুসলমানের অস্ত্র। কিন্তু ভাবুন শুধু অস্ত্র থাকলেই কি কাজ হয়? অস্ত্র নিয়ে তো ময়দানে নামতে হয়। সিলেটে একটা প্রবাদ আছে, 'দুআয় ফুআ অয় না'—মানে শুধু দুআ করলেই আপনার ছেলে হয়ে যাবে না, ছেলের জন্য প্রথমে আপনাকে বিয়ে করতে হবে।

যেহেতু আল্লাহ বলেছেন, ধৈর্য ও নামাজের মাধ্যমে সাহায্য প্রার্থনা করো। এখন আমাদেরকে বেশি বেশি নফল নামাজের মাধ্যমে সাহায্য প্রার্থনা করতে হবে আর ধৈর্য ধরতে হবে। ধৈর্যের কথা কেন বলছেন আল্লাহ তাআলা? যারা সুখে আছে তাদের আবার কীসের ধৈর্য!

ধৈর্য ধরার মানে আপনাকে কষ্ট স্বীকার করতে হবে। এইভাবে সুখে জীবন যাপন করলেই হবে না। অন্তত সামান্য হলেও নিজেকে দ্বীনের জন্য উৎসর্গ করতে হবে। গাজওয়া হলে বিজয় মুসলমানের। ওই আশায় আপনি বসে আছেন, কিন্তু এই বিজয়ের পূর্বের পটভূমিতে কতটুকু আপনার সময় আছে, কতটুকু আপনার শ্রম আছে, তা কি কখনও ভেবে দেখেছেন?

বিজয় কি এমনি এমনিই চলে আসবে? পরিবার পরিজন সবাইকে ছেড়ে, অচেনা ভূমিতে নিঃস্ব অবস্থায় পাড়ি দিয়েও সাহাবাদের কাছে বিজয় আসেনি, তাদেরকে যুদ্ধ করতে হয়েছে, রক্ত দিতে হয়েছে, নিজের জীবনের পুরো সময়টাই উৎসর্গ করতে হয়েছে। আর আমরা চাই, আমরা কিছু করব না, করোনা ভাইরাস এসে জালিমদের ধ্বংস করবে, আসমানী সাহায্য এসে আমাদের উদ্ধার করে দিয়ে যাবে, আর আমরা বসে বসেই সব পেয়ে যাব! এ যেন বনী ইসরাইলের চিরাচরিত সেই কথা, হে মুসা, তুমি ও তোমার আল্লাহ যাও যুদ্ধ করো, বিজয় হলে আমরা আছি!'

আপনি একটুও কষ্ট স্বীকার করলেন না, অন্তত দশ বিশ রাকাত নফল নামাজ পর্যন্ত পড়তে পারলেন না। আপনি আপনার জীবনের সামান্য সময় আশেপাশে দ্বীন প্রসারের জন্য উৎসর্গ করলেন না। কান্না কি আপনাকে মানায়?

ইলাল উখতিল মুসলিমা বইটিতে নারীর করণীয় নিয়ে বিস্তারিত আলাপ আছে, আমার পরিচিত অনেক বোন বইটি কিনেছে, কিন্তু আমি জানি অনেকে পুরো বইটা পড়েও দেখেনি, আর যারা পড়েছে তাদের কয়জন আছে যে, পরিবর্তনের জন্য একটা উদ্যোগ, একটা ছোট্ট উদ্যোগ নিয়েছে। হাতেগোনা দুয়েকজন ইনবক্সে আমাকে উদ্যোগ নেয়ার কথা জানিয়েছে। কিন্তু কয়জন বোন আছে, নিজের আশেপাশের মা বোনদের নিয়ে তালিমে বসবে, কুরআনের তাফসীর শুনাবে, সীরাত পড়ে শুনাবে, প্রেরণায় উম্মাহর নারীদের উদ্বুদ্ধ করবে, যেন বাংলার প্রতিটি সন্তান হয় একেকটি বিন কাসিম। বড় বড় স্যাক্রিফাইস তো দূরে থাক, অসংখ্য মহিলার নামাজে পাঠের জন্য জরুরী সূরাগুলো পর্যন্ত শুদ্ধ নয়। দুআয়ে কুনুতে প্রায় সবারই ভুল আর ভুল। এইগুলো বাস্তব অভিজ্ঞতা। কিন্তু কেউ নেই যে দরদ নিয়ে নিজের খাদেমাকে নামাজটা শুদ্ধ করে শিখিয়ে দিবে। আশেপাশে নারীদের বুকে দ্বীনের মশাল জ্বালিয়ে দেবে!

যুদ্ধ হোক, সেই যুদ্ধে জীবনের সমাপ্তি ঘটুক আমাদের সন্তানদের, আমাদের আশেপাশের জীবনের। কিন্তু তাদের মৃত্যু যেন হয় শহীদের মৃত্যু। আত্মতৃপ্তির মৃত্যু। তারা যেন দেশের জন্য লড়াই করে না মরে, তারা যেন জাতীয়তাবাদের জন্য না লড়ে মরে, তারা যেন মরার জন্যই না মরে। তারা যেন মরে এক আল্লাহর দ্বীনের জন্য। আর তাদের বুকে এই প্রেরণা, এই পিপাসা শুধু আমিই জাগাতে পারি। আল্লাহর দয়ায় এই কাজ আমি সহজেই করতে পারি। আমার কি আসলেই কিছু করার নেই?


[১] Asif Adnan, 27/02/2020, 04:05

[২] Majida Rifa, 27/02/2020, 05:56