প্রিয় রফিক,
আজ কেন যেন হঠাৎ করেই তোর সাথে আমার দেখা হওয়া শেষ দিনটার কথা মনে পড়ছে রে খুব। তুই সাদা বিছানাটায় শুয়ে যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছিস, তোর পা দুটো ফুলে ঢোল। ভেতরে টলটল করছে পানি জাতীয় তরল। হাত দিয়ে ছুয়ে দিতেই সেটা বেলুনের মতো ডেবে ভেতরে ঢুকে যাচ্ছে। যন্ত্রণায় কাতরাতে কাতরাতে আমাকে একবার বললি, ”সৌরভ ছুরি আন তো! একটু কেটে দেখনা কী হইছে ওইখানে? এরকম করে কেন? প্লিজ!" এর ঠিক কয়েক মুহূর্ত পরেই তুই আবার আমাকে চিনতে পারছিস না। এলোমেলো, শূন্য চোখে দেখছিস এদিক-ওদিক। হাঁপাচ্ছিলি খুব বিশ্রীভাবে।
আল্লাহ তায়ালা আমাকে অনেক ক্ষমতা দিলেও কেন যেন কাঁদার ক্ষমতাটা দেননি। প্রবল শোকেও আমার চোখে জল আসে না। সেদিন খুব খুব ইচ্ছে হচ্ছিল একটু কাঁদি। চিৎকার করে কাঁদি। আমার বুকে চেপে বসে থাকা অদ্ভুত শূন্য অনুভূতিগুলোকে শক্তির রূপান্তর সূত্রে ফেলে দিয়ে রূপান্তরিত করে ফেলি; ছড়িয়ে দেই অন্যত্র বা সর্বত্র। জানিস? বিস্ময়করভাবে কখনো কখনো এই পাষাণ আমার চোখটাও ঝাপসা হয়ে উঠেছিল সেদিন। আচ্ছা, তুই কি দেখেছিলে আমার সেই গোপন অশ্রুর ফোঁটাটা? তুই কি কখনো জানতে পারবি? ঠিক কতোটা ভালবাসা আমি তোর জন্য জমিয়ে রেখেছিলাম? ঠিক কতোটা অনুভূতি লুকিয়ে রেখে সেদিন আমি তোর পায়ের কাছে অসহায়ের মতো বসে ছিলাম?
তোর কি মনে পড়ে রফিক? ছোটবেলায় ঈদের দিনগুলোতে আমরা যখন গ্রামের বাড়ি যেতাম; পুকুরে ইটের চারা দিয়ে দুজনে ব্যাঙ লাফ খেলতাম? আমি কোনদিনই ঠিকমতো খেলতে পারতাম না খেলাটা। আমার ছোঁড়া ঢিলগুলো কেন যেন সবসময়ই ডুবে যেত, এলোমেলো ভেসে যেত এদিক ওদিক। আর তোর ছোঁড়া ঢিলগুলো ছপাত ছপাত শব্দে অনুরণন তুলে এগিয়ে যেত বিদ্যুৎ গতিতে। জানিস রফিক? এখন আমিও টলটলে কালো জলে ব্যাঙ লাফ খেলা শিখে গেছি। সেই সাথে সাথে শিখে গেছি আরও অনেক অনেক কিছু। তোর মত আমার একটা ভাই ছিলো সেটা আমি ভুলতে শিখে গেছি। তোর মত আমার একটা বন্ধু ছিল সেটা আমি ভুলতে শিখে গেছি।
জানি শুনতে খুব খারাপ লাগবে কিন্তু সত্যটা হলো তোকে আমরা প্রায় সবাই-ই ভুলে গিয়েছি। এটাই সত্য। অবিনশ্বর সত্য। এ পৃথিবীটাতে আমরা মাত্র অল্প ক'টাদিনের জন্য ঘুরতে, বেড়াতে আসি। এ বেড়ানোর এক ফাঁকে কিছু মুখ আমাদের খুব কাছের হয়ে যায়। ভালোবাসার হয়ে যায়। তাদের ভালোবাসা, সান্নিধ্য আমাদের ভুলিয়ে দেয় যে প্রকৃতপক্ষে আমরা একা। সবাই একা। একেকজন একেকটা বিচ্ছিন্ন দ্বীপ যা একে অপরের সাথে খুব দুর্বলভাবে ক্ষণিকের জন্য যুক্ত হয়ে আছে। অপেক্ষা শুধু একটা বড়সর ঢেউ এসে শেষ করে দেবার। ঢেউয়ের শেষেই আবার সেই একাকিত্ব, বিচ্ছিন্নতা, ভয়াবহতা। হোক সে মা, বাবা, ছেলে, মেয়ে বা যত কাছের মানুষ। মৃত্যুর পর বড়জোর দু'টো সপ্তাহ আমাদের চোখে জল আসে। এরপর ধীরে ধীরে এমন একটা পরিবেশের সৃষ্টি হয় যে মৃত ব্যক্তির নামটা ভুলেও কারো মুখে চলে এলে সবাই প্রবল অস্বস্তিতে ভুগতে থাকে।
জীবনটা আসলে এমনই। কারো জন্যই কখনো থেমে থাকে না। জীবন চলবে তার নিজস্ব গতিতে, নিজস্ব স্রোতে। এই যে এত এত মানুষের ভালবাসা। এত এত গুরুত্ব আজকে মানুষ আমায় দিচ্ছে। আসলে কি সত্যিই এসবের কোন মূল্য আছে? আমি এখন মারা গেলে আগামীকাল তো কেউ আমার জন্য অপেক্ষা করবে না। কেউ আমার জন্য ভাববে না। অফিসের কাজ, বন্ধুদের আড্ডা কোন কিছুই থেমে থাকবে না আমার জন্য। তাহলে কেন আমরা জন্ম হওয়ার ঠিক পর মুহূর্ত থেকেই মানুষকে খুশি করবার জন্য, তাদের কাছ থেকে একটুখানি বাহবা পাওয়ার জন্য আমরা ছুটে চলি? আমরা তো সবাই ফিরে যাব আমাদের রব, আমাদের সৃষ্টিকর্তা, আমাদের পালনকর্তা এক আল্লাহর কাছে।
এতো এতো মানুষকে খুশি না করে শুধু এক আল্লাহকে খুশি করার একটুখানি চেষ্টা করাটাই আমাদের জন্য বুদ্ধিমানের কাজ নয় কি? একটা কথা এখন বুঝি ভাই। তোকে আমি অনেক ভালবাসি। কিন্তু তোর কোন উপকার করার বিন্দুমাত্র সামর্থ্য আমার আর নেই। কিছুই করতে পারব না তোর জন্য। আমরা প্রত্যেকেই নিজেরা নিজেদের কর্মফল ভোগ করবো। তবুও আমি স্বপ্ন দেখি ভাদ্র মাসের শান্ত নদীর ধারে টলটলে কোন নদীর সামনে দাঁড়িয়ে—আমি আর তুই। গায়ের সমস্ত জোর দিয়ে আমি ইটের চারাগুলোকে ভাসিয়ে ওঠানোর চেষ্টা করছি। পারছি না। বারবার ভুল হচ্ছে। তুই আমার হাত ধরে আবার আমাকে শেখাচ্ছিস। বলছিস, গাধা এটাও পারস না…. কখনো কি হবে আবার ভাই?? ইনশাআল্লাহ হবে। দেখা হবে জান্নাতে। জান্নাতুল ফিরদাউসে।
- ইতি, আমি
মঙ্গলবার, ১৫ এপ্রিল, ২০১৪