স্পর্ধা ৩: বক্রতা, ইলহাদ
শারীআতে মুহাম্মাদীকে আল্লাহ তাআলা সুরক্ষিত রেখেছেন। কীভাবে সংরক্ষিত রেখেছেন, সেটা নিঃসন্দেহে আরেক মুজেযা। কী এক আশ্চর্য উপায়ে আল্লাহ:
-- তাঁর কালামকে সংরক্ষিত রেখেছেন (একেবারে নবীজীর জীবদ্দশা থেকে আজ অব্দি একটানা, লিখিত-মুখস্ত ২ ভাবেই, প্রতি প্রজন্মেই বহু-সংখ্যক লোকের দ্বারা)
-- কালামের ভাষাকে সংরক্ষণ করেছেন (আরবি ভাষা দুনিয়ার সবচেয়ে 'অ-তরল' মানে কম পরিবর্তিত ভাষা, বিস্তারিত সামনে ইনশাআল্লাহ)
-- কালামের ব্যাখ্যাকে সংরক্ষণ করেছেন (নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের হাদিস। এটাও তাঁর জীবদ্দশা থেকে একটানা লিখিত-মুখস্ত, দুটোই। উদাহরণটা একটু কেমন হয়, তারপরও বলি। গার্মেন্টস থেকে প্রোডাক্ট ডেলিভারির সময় একটাতে খুঁত পেলে যেমন পুরো লট বাতিল, একেবারে তেমন করে সংরক্ষণ হয়েছে আল্লাহর রসূলের মুখের কথা)
-- কালাম যার উপর নাযিল হয়েছে, তাঁর জীবন-চরিত কে সংরক্ষণ করেছেন। (হাদিসের মতো করেই)
-- কালামের বুঝ সংরক্ষণ করেছেন। এই কালামের প্রথম ছাত্ররা যা বুঝেছেন, যেভাবে প্রয়োগ করেছেন শিক্ষক রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছ থেকে, সেটাকেও একইভাবে সংরক্ষণ করেছেন।
-- প্রথম ছাত্রদের, তাদের ছাত্র, তাদের ছাত্র, তাদের ছাত্র এভাবে যারা যারা প্রতি জেনারেশনে তাঁর কালাম-ব্যাখ্যা-বুঝ-ইতিহাস বহন করে পরের জেনারেশনে পৌঁছে দিয়েছেন, তাঁদের সবার জীবন-চরিত, চরিত্র বিশ্লেষণ সংরক্ষণ করেছেন। এই শাস্ত্রের নাম 'আসমাউর রিজাল'।
ধরেন, নবীজীর এক হাদিস হঠাৎ করে উদয় হল, যেটা কেউ শোনেনি। তখনই সেটার উৎস খোঁজা হবে, কোন চেইনে (সনদ) কথাটা এলো। এই বর্ণনা চেইন ছাড়া একটা লাইনও পাত্তাই পাবেনা। নতুন করে কিছু ঢুকবার সুযোগই নেই। না, কালামের আয়াত, না হাদিস, না নতুন কোনো ব্যাখ্যা, না নতুন কোনো বুঝ। এরপর দেখা হবে, সেই চেইনে কারা কারা আছে, এই হাদিসের বাহক কারা প্রজন্মান্তরে। তাদের জীবনী সংরক্ষিত। বের করা হবে ৮০ ভল্যুম, ৬০ ভল্যুমের সেসব বই। এমন কেউ যদি চেইনে থাকে যার নাম এসব বইয়ে নেই (মাজহুল/অজ্ঞাত), নগদে সে হাদিস বাদ। এমন কেউ যদি থাকে যার নামে অবজেকশন আছে, হয় সে মিথ্যুক, নয় হাদিস জালের হিস্ট্রি আছে, সাথে সাথে বাদ। কী কী খুঁত থাকলে হাদিস বাদ হবে, কী খুঁত থাকলে বাদ হবে না তবে ওজন কমে যাবে, দালিলিক গুরুত্ব কমে যাবে। সবখানে সে হাদিস ব্যবহারযোগ্য থাকবে না। আকীদা প্রমাণের জন্য কোন লেভেলের হাদিস, বিধান প্রমাণের জন্য কোন লেভেল, উৎসাহ-সতর্কবাণী প্রমাণের জন্য কোন লেভেলের, ইতিহাস প্রমাণের জন্য কোন লেভেলের বর্ণনা নেয়া যাবে, এগুলো সব নীতিমালা করা রয়েছে।
সুতরাং মনে চাইল একটা হাদিস বানিয়ে ঢুকোলাম, একটা হাদিস মনমতো ব্যাখ্যা মেরে দিলাম, কুরআনের আয়াতের একটা ব্যাখ্যা দিয়ে দিলাম, সে সুযোগ ইসলামে নেই। ইসলাম হল আল্লাহ যা নাযিল করেছেন (কুরআন-হাদিস), নবীজী যা বুঝেছেন, যা বুঝিয়েছেন। সাহাবীরা যা বুঝেছেন-বুঝিয়েছেন। এটুকু যুগের সাথে সম্পর্কিত নয়। কুরআন সেই যুগে নবী এটা বুঝেছেন, সাহাবীদের এটা বুঝিয়েছেন। আজকের যুগে আমরা অন্যভাবে বুঝবো, সে সুযোগ নেই। কাণ্ডজ্ঞান খাটিয়ে সুপ্রতিষ্ঠিত হাদিস, সুপ্রতিষ্ঠিত বুঝ বাইপাস করার সুযোগ নেই।
ইসলাম এসে যুগকে বদলায়, দেশকে বদলায়, মানুষকে বদলায়। যুগভেদে, দেশভেদে, জাতিভেদে ইসলাম বদলায় না। বর্তমান যুগের খাপে নবীজীর হাদিস সেট করতে চাই অনেকে, কুরআনের আয়াত সেট করতে চাই। এটা ভুল। বর্তমান যুগের খাপে কুরআন-হাদিস বসবে না, বরং কুরআন-হাদিস-আদি বুঝের খাপে যুগ বসবে। এটাই ইসলামের বৈশিষ্ট্য। সায়্যিদ কুতুব রহ. বলেছিলেন: 'ইসলাম ছাড়া বাকি সব জাহিলিয়্যাত। শুধু ইসলামই সভ্যতা'। আসলেই তাই। আজ আমরা জাহিলিয়্যাতকে পরম ধরে ইসলামকে ভ্যারিয়েবল নিচ্ছি।
অবিবাহিত নারী-পুরুষ সম্পর্ককে স্বাভাবিক ধরে নিয়ে তার থেকে সাহাবাদের 'কোর্টশিপ' টেনে বের করছি।
ব্যভিচারকে, সমকামকে, শিরক-কে একটা 'অধিকার' ধরে নিয়ে বলছি 'ইসলাম মানবাধিকারের কথা বলে'।
জন্ম-নিয়ন্ত্রণকে আগে অপরিহার্য ধরে নিয়ে এরপর সাহাবাদের আযল (withdrawl method) এর দলিল খুঁজে বের করছি। তাই বলে জায়েয হয়ে গেল পিল খাওয়া, যার রয়েছে ভয়াবহ শারীরিক ক্ষতি? জায়েয হয়ে গেল চামড়ার ইমপ্ল্যান্ট, ভ্যাসেকটমির মত সৃষ্টি-বিকৃতি?
জাতিরাষ্ট্র সীমাকে সর্বৈব পরম ধরে নিয়ে লজিক দিচ্ছি, তাহলে বাংলাদেশে জনসংখ্যা বেড়ে যাবে যে!
গণতন্ত্র-ধর্মনিরপেক্ষতা-মানববাদ-ব্যক্তিস্বাধীনতার খাপ অপরিবর্তনীয়। খালি আল্লাহর কালাম-রাসূলের হাদিস-সাহাবায়ে কেরামের বুঝই মোয়া? আল্লাহকেই আমার চিন্তার মাঝে ফিট হতে হবে? আল্লাহর রাসূলকেই আমার মানসিকতায় সেট হতে হবে? আমি আত্মসমর্পণ করছি, নাকি আল্লাহ-রাসূলকে বলছি আমার কাছে আত্মসমর্পণ করতে?
কুরআনের আয়াত, নবীজীর হাদিসের বক্র অর্থ করা এক বিশেষ প্রকারের কুফর। এমন অর্থ করা যা গত ১৪০০ বছরে আল্লাহ কর্তৃক সংরক্ষিত ঐ বিধানের চেহারা-অর্থ-বুঝ-স্বরূপ থেকে ভিন্ন। একে বলে 'ইলহাদ', যে করবে তাকে বলা হবে মুলহিদ। আমার আপনার মনের কাছে এগুলো আত্মসমর্পণ করে না। হয় আমি এগুলোর কাছে নিজেকে মিটিয়ে দেব, নচেৎ ইসলাম আমাকে সশব্দে ডিজ-ঔন করবে। এবং আমার বাকি সব আমল নষ্ট হয়ে যাবে। হাশর হবে কাফিরদের সাথে।
إِنَّ الَّذِينَ يُلْحِدُونَ فِي آيَاتِنَا لَا يَخْفَوْنَ عَلَيْنَا ۗ أَفَمَن يُلْقَىٰ فِي النَّارِ خَيْرٌ أَم مَّن يَأْتِي آمِنًا يَوْمَ الْقِيَامَةِ ۚ اعْمَلُوا مَا شِئْتُمْ ۖ إِنَّهُ بِمَا تَعْمَلُونَ بَصِيرٌ
(সূরা ফুসসিলাতঃ আয়াত ৪০ এর তাফসীর, তাফসীরে মাআরেফুল কুরআন দ্রষ্টব্য)
ইসলাম 'আধুনিক' 'সর্বাধুনিক' ধর্ম। এর মানে এটা নয় যে, বর্তমান আধুনিকতার সংজ্ঞায় ইসলামকে আসতে হবে। আপনার আমার আধুনিকতার খাপে ইসলামকে ঢুকতে হবে। বরং 'ইসলাম আধুনিক' মানে হল ইসলামটাই আধুনিক, বাকি সব অ-আধুনিক। আমাকে আপনাকেই আমাদের মূর্খতা থেকে ইসলামের আধুনিকতায় এসে ঢুকতে হবে। ইসলাম কোনো সমঝোতায় আসে না। আর যদি আমি আমার কুফরী চিন্তা-চেতনা, জাহেলী জীবন-বোধ, জুলমী-সিস্টেম এর সাথে ইসলামের সমঝোতা চাই, তবে যেন আমি জেনে নিই 'লাকুম দীনুকুম ওয়া লিয়া দীন'। আমার জাহেলী দীন, আমার সোকল্ড আধুনিক চিন্তাচেতনার সাথে ইসলামের কোনো সম্পর্ক নেই। ইসলাম ইসলামের মতো, আমি আমার মতো।