মেয়েদের 'হায়া' বললে তো চট করে বুঝে ফেলি আমরা। নারীর ভূষণই না কেবল, ইসলামী কালচারে পুরুষেরও অলংকার এই লজ্জা। পুরুষের জন্যও ইসলাম 'হায়া'র কিছু বিধানকে ফরয করেছে, কিছু মুস্তাহাব, কিছু আদব, আবার কিছু আছে কিছুই না, স্রেফ আত্ম-লজ্জা। উপরের হাদিসটা মনে করুন: ‘আল্লাহ লজ্জাশীল, ভালোওবাসেন লজ্জাশীলদের’।
• পুরুষের নাভি থেকে হাঁটু সর্বাবস্থায় ঢেকে রাখা
• চোখ নামিয়ে চলা
• গাইরে মাহরাম (যাদের সাথে বিবাহ বৈধ) নারীদের এড়িয়ে চলা
• বেশভূষায়, চুলের কাটে ইসলামী কোড মেনে চলা। যেমন ধরেন ‘ঘোড়া-কাট’। সব ঠিক আছে, ‘হায়া’ নাই।
• পুরুষ হয়ে নারীর পোশাক না পরা
• স্বচ্ছ পোশাক না পরা
পারিবারিক কিছু ‘হায়া’ (আত্মলজ্জা) আছে। এখন মুসলিম পরিবার থেকে ‘হায়া’ বিদায় নিয়েছে। পুরো পরিবার একসাথে বসে ফরাসি-চুম্বনদৃশ্য উপভোগ করছে। ‘লিটনের ফ্ল্যাট’-টাইপ নোংরা ডায়লগ বাপের সাথে মেয়ে বসে দেখে।
অভিনেতাদের পোশাকে ‘আই অ্যাম পর্নস্টার’, ‘ব্লো-জব’, ‘ডগিস্টাইল’ লেখা, সবাই মিলে দেখছে। ছেলের সাথে মা বসে দেখে, ভাইবোন একসাথে দেখে। নায়ক নায়িকাকে বুকে জড়িয়ে নিচ্ছে, থুতনি উপরে তুলে ধরে এরপর দুটো ফুল একটা আরেকটাকে ঠোকরাচ্ছে—এ ধরনের সিম্বোলিক দৃশ্য তো একদমই স্বাভাবিক হয়ে গেছে আরও আগে। গুনাহের প্রতি ঘৃণা উঠে যাওয়া ঈমানহীনতা আলামত। হাদিস আমাদেরকে জানিয়েছে: অন্তরে ঘৃণা করার নিচে আর ঈমানের স্তর নেই। তাহলে এইসব জঘন্য অশ্লীলতার প্রতি ঘৃণা উঠে যাওয়া, এগুলোকে নর্মাল মনে হওয়া কীসের আলামত?
যেকোনো খারাপ বিষয় নর্মালাইয করার কয়েকটা ধাপ আছে। প্রথমে সেটাকে সবাই ঘৃণা করত। এরপর সেটা নিয়ে ঠাট্টা তামাশা করে। এরপর সেটা সিম্প্যাথাইয করে, ওর কী দোষ। এরপর সেটা নর্মাল হয়ে যায় সমাজে। পর্নো, সমকামিতা এখন আমাদের সমাজে ঠাট্টার স্তরে আছে, একটা সময় ঘৃণার বিষয় ছিল। বিনোদনের নামে (নাটক-সিনেমা) মিডিয়া এই কাজগুলো করে। ছেলে-মেয়ে লিভ-টুগেদার আমাদের সমাজে একটা ঘৃণার জিনিস ছিল। ‘লিটনের ফ্ল্যাট’ জাতীয় ডায়লগ ও নাটকের দ্বারা এগুলোকে প্রচলিত করে দেয়া হয়েছে হাসি-ঠাট্টা হিসেবে। পরের ধাপে সেটা নর্মাল একটা ব্যাপার হয়ে যাবে, বা অলরেডি গেছে। সমাজে গ্রহণযোগ্য একটা সম্পর্কে পরিণত অলরেডি হচ্ছে। যেমন ধরেন প্রেম-টা। একসময় আমাদের বাবাদের যুগেও সামাজিকভাবে ঘৃণ্য একটা ব্যাপার ছিল, এখন নাটক-সিনেমার সুবাদে ‘কিছুই না’ হয়ে গেছে। টিভি প্রোগ্রামগুলো আমাদের মনস্তত্ত্ব গঠনে গভীর প্রভাব ফেলে। একই ধরনের মেসেজ বার বার পেতে পেতে, একই ধরনের সিনারিও বার বার দেখতে সেটাকে বাস্তবজীবনেও স্বাভাবিক মনে হয়। ‘ও তো জাস্ট অভিনয়’— এভাবে ফু মেরে উড়িয়ে দিলেও ব্যাপারটা আসলে এমন না। ঘটনাপ্রবাহ, পটভূমি, সিনারিও, চরিত্রায়ন, ডায়লগ, পোশাক, ভাষা, ভঙ্গিমা সকল কিছু দিয়ে ছড়িয়ে দেয়া হয় ‘হায়া’বিরুদ্ধ, ইসলামের সাথে সম্পূর্ণ সাংঘর্ষিক সব জীবনাচরণ— বে‘হায়া’পনা, অশ্লীলতা, ফাহশা’।
মিডিয়াকর্মীদের মাঝে যারা এখনও নিজেদের মুসলিম ভাবেন, আখিরাতে উপর, বিচার দিবসে জবাবদিহিতার উপর এখনও বিশ্বাস করেন, তাদের জন্য জাস্ট একটা আয়াত কুরআনের। কোনো তাফসীর দরকার নেই, এমন দিবালোকের মত স্পষ্ট আয়াত।
• ‘যারা চায় ঈমানদারদের মাঝে অশ্লীলতা ছড়িয়ে যাক তারা দুনিয়ায় ও আখেরাতে ভোগ করবে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি’ [আন নূর: আয়াত নং- 19]
যন্ত্রণাদায়ক আযাব দুনিয়াতেও, আখেরাতেও। খেয়াল করলে দেখবেন অধিকাংশ মিডিয়াকর্মী, নাট্যভিনেতা-অভিনেত্রীর জীবন সুখের হয়না। ড্রাগ-ডিভোর্স-পরকীয়া-ড্রিংক্স-আত্মহত্যা প্রভৃতির ঘূর্ণাবর্তে এক অস্থির জীবন কাটায় তারা। পত্রপত্রিকাতেই অহরহ আমরা পেয়ে থাকি। এটা তাদের জন্য দুনিয়ার আযাব। এটা এজন্য যে, তারা মুসলিম সমাজে অশ্লীলতার প্রসার ঘটাতো, পশ্চিমের অশ্লীল জীবনাচারকে নর্মালাইয করত। আর এর চেয়ে শতসহস্রগুণ শাস্তি তারা ভোগ করবে আখিরাতে।
বহু মুসলিম ভাই, যারা আখিরাতে জবাবদিহিতায় বিশ্বাসী তারাও নিজেদের অজান্তেই এই গর্হিত গুনাহ করে যাচ্ছেন। অনেকের জীবিকা উপার্জনের উপায়ই (ক্যারিয়ার) এটি, অশ্লীলতার প্রসার। হারাম উপায়ে অর্জিত অর্থও হারাম হয়ে যাচ্ছে তাদের অজান্তে। বিনোদনের নামে জনপ্রিয়তা অর্জনের দিকে তাদের ঝোঁক। জনপ্রিয়তা, নিশ্চিন্ত জীবিকা— এগুলো ভেদ করে আল্লাহর আহ্বান কানে আসাই কঠিন হয়ে যায়। দুনিয়ার জীবনের এসব ধোঁকা থেকে আল্লাহ কুরআনে বারবার সতর্ক করেছেন। অনেকে আল্লাহর দয়ায় উঠে আসতে পারেন এই পঙ্কিল জীবন থেকে। আল্লাহর জন্য বিসর্জন দেয়া জনপ্রিয়তা ও জীবিকা আল্লাহ দুনিয়াতেই তাদেরকে ফিরিয়ে দেন শতগুণে, হালালের মাঝে। জুনাইদ জামশেদ রহ. এর উদাহরণ আমাদের সামনেই রয়েছে।
মিডিয়া দ্বারা প্রচারিত বা ইন্সটিলড এই সিনারিওগুলো দর্শকের কাছে বাস্তবজীবনে এভেইলেবল করে দেয় সহ-শিক্ষা ও সহ-কর্ম। নাটক-সিনেমার মাত্র শোনা-দেখা (প্রিয় অভিনেতা-অভিনেত্রীর) ডায়লগ, ভঙ্গিমা, ভাষা, চরিত্রায়ণগুলো ফ্যানরা এখানে প্র্যাক্টিস করে। এটাই প্রমাণ করে এগুলো কেবলই নির্দোষ ‘অভিনয়’ নয়, এগুলোর গভীর মানসিক ও সামাজিক প্রভাব রয়েছে। আপনারা বহু ঘটনা পাবেন যেখানে ‘ক্রাইম পেট্রোল’ জাতীয় প্রোগ্রাম থেকে অপরাধের আইডিয়া নেয়া হয়েছে। আমি বলতে চাইছি— এগুলো থেকে ‘নেয়া’ হয় অনেক কিছুই।
‘হায়া’ মানুষের এক্সক্লুসিভ বৈশিষ্ট্য। পশুর কাছে নিজের চোখ আর লজ্জাস্থান সমান। কুকুর তার জিভও বের করে রাখে, তার পায়খানার রাস্তাও বের করে রাখে। সবই তো অঙ্গ, লজ্জার কিছু নেই। ‘লজ্জার কী আছে?’ এটা পশুর মুখে মানায়। বস্তুবাদ বা মানব ইতিহাসের বস্তুবাদী দর্শন (ডারউইনিজম) মানুষকে একটা উন্নত পশু ছাড়া আর কিছু হিসেবে দেখেনা। তাই বস্তুবাদীদের কাছে ‘লজ্জা’ অনর্থক একটা শব্দ, কারণ বস্তুবাদ দিয়ে ‘লজ্জা’কে ব্যাখ্যা করা যায় না। অথচ মানবেতিহাসের শুরু থেকেই মানুষ লজ্জা পেয়েছে, পোশাক পরেছে। লিঙ্গ আর হাতের পার্থক্য করেছে, যদিও দুটোই শরীরের প্রত্যঙ্গ। এটা মানুষেরই বৈশিষ্ট্য। যে কারণে আমরা মানুষ, যেকারণে আমরা জন্তু নই, এগুলো সেই বৈশিষ্ট্য যা আমাদের মানুষ করেছে। কোনো পশু লজ্জা পায়নি, কোনো পশু ধর্ম পালন করেনি, কবিতা লেখেনি। এজন্য শুধু বস্তুবাদ দিতে মানুষকে ও মানুষের ইতিহাসকে ব্যাখ্যা করা যায় না, শুধু ভাববাদ দিয়েও যায় না। ড. আলিজা আলী ইজাতবেগোভিচ তাঁর ‘Islam between East and West’- বইয়ে চমৎকারভাবে এটা আলোচনা করেছেন। ইসলামই মানুষের সত্তা ও প্রশ্নগুলোর পরিপূর্ণ উত্তর দেয়। বস্তুবাদ ও ভাববাদের সমন্বয় করেছে ইসলাম, মহান স্রষ্টার পক্ষ থেকে শেষ নির্দেশনা। মানুষ বলেই আমাদের কাছে আমার শার্ট আর জাঙ্গিয়া এক জিনিস না, যদিও দুটোই পোশাক। মানুষ বলেই আমরা পিরিয়ডের রক্ত দেখিয়ে রাস্তায় ঘুরতে পারিনা। মানুষ বলেই আমরা লিপস্টিক নিজে কিনে, প্যাড বাপকে দিয়ে কেনাতে পারিনা। মানুষ বলেই নিজেদের অন্তর্বাস ছাদে মেলে তার পিক ফেসবুকে আমরা দিতে পারিনা। এগুলো যতখানি ‘লোকলজ্জা’র বিষয়, এর চেয়ে বেশি ‘আত্মলজ্জা’র বিষয়। মনুষ্যত্ব মানে ধর্ম ছেড়ে দিয়ে ‘হিউম্যান’ হওয়া নয়। যদি বিবর্তন সঠিক ধরেও নিই, বস্তুবাদের অবোধ্য এই বিষয়গুলোকেই মনুষ্যত্ব বলে। এগুলোই অন্যান্য জন্তু থেকে আমাদের আলাদা করেছিল, আমাদেরকে ‘এপ’ থেকে ‘ম্যান’ করেছিলো।
তো আমি বলতে চাচ্ছিলাম যে, সমাজে বে‘হায়া’পনা ছড়ানোর শাস্তি হিসেবে আল্লাহ আযাব পাঠান। সমাজে অশ্লীলতার প্রসারে কিছুই করতে আমরা বাকি রাখিনি। পোশাকের ডিজাইন থেকে নিয়ে নাটক, পত্রিকার বিনোদনপাতা থেকে নিয়ে গানের লিরিক্স— প্রতিটি রাস্তাকে ব্যবহার করে আমাদের সমাজে ‘হায়া’কে নষ্ট করা হয়েছে।আজ দেখেন চারিদিকে। মুসলিম-সন্তানদের আমরা ‘হায়া’ শেখাতে পারিনি। পাশ্চাত্য সভ্যতার অনিবার্য পরিণতি হিসেবে ওদের মত আমাদের সমাজ থেকেও ‘হায়া’, শ্লীলতা, মডেস্টি, ডিসেন্সি শব্দগুলো উঠে গেছে। যা গোপনে করা হত, তা প্রকাশ্যে করা হয়। সমকামিতার মত ঘৃণার্হ কাজকে ‘অধিকার’ হিসেবে দাবি করা হয়। ব্যক্তিস্বাধীনতার পশ্চিমা সংজ্ঞা গ্রহণ, নারীবাদ ও এলজিবিটি আন্দোলনের নামে নির্লজ্জতাকে মূলধারায় আনা, স্কুলে যৌনশিক্ষার নামে ‘হায়া’ ভাঙানো, নাটক-সিনেমা-বিনোদনের নামে পারিবারিক ‘হায়া’ ধ্বংস করা— আর কী কী বাকি রেখেছি আমরা।
ফিরে যাই শুরুতে। লূত আ. এর কওমে তিনিই ছিলেন সংখ্যালঘু, এমনকি তাঁর স্ত্রীও ছিলেন অশ্লীল-মতাদর্শী। আজ আপনি সমাজে অশ্লীলতার বিরুদ্ধে কিছু বলে দেখেন, আজ এই পোস্টে যা বললাম এগুলো বলেন। আপনিও টের পাবেন আপনি সংখ্যালঘু। আপনার স্ত্রী-বোন-বেস্টফ্রেন্ডও আপনার বিরুদ্ধে চলে যাবে। লূত আ. এর জাতি তাঁকে শাসিয়েছিল: ‘বেশি পবিত্র সেজেছো, বেশি পবিত্র হতে চাও?’ আপনার জাতি আপনাকে শাসাবে: ‘বেশি হুজুর হয়েছো, উগ্রবাদ ভালোনা, নাটক দেখেনা তো জঙ্গিরা’। তাই যদি হয়, প্রবল পরাক্রমশালী সর্বশক্তিমান আল্লাহর রোষ কেন আসবে না, সেইটে আমাকে বুঝায়ে বলেন।
‘করোনা’ কেন শুধু, খেল তো সবে শুরু। এ তো একটা, পিকচার আভি বাকি হ্যায়। তবু যদি আমরা কেউ কেউ ফিরে আসি। তবু যদি আমাদের কারও হুঁশ হয়। আসেন আমরা আমাদের পরিবারের পক্ষ থেকে তওবা করি, আত্মীয়-বন্ধুদের পক্ষ থেকে করি, পুরো উম্মতের পক্ষ থেকে তওবা করি। ফিরে আসি। ‘ইন্না আযাবাকা বিল কুফফারি মুলহিক্ব’। আয় মালিক, আপনার আযাব কাফেরদের জন্য। আল্লাহ! আমরা আপনাকে চিনি, আপনার আযাবকে ভয় করি। আল্লাহ! আমরা ঈমান এনেছি, আমাদের মাফ করে দেন। আমরা আর ফিরে যাবোনা আগের জীবনে। এবারের মত আমাদের মাফ করে দিন।