★ ক্যারিয়ারে সেক্যুলার:
বিগত পর্ব পড়ে হয়ত নিজেকে দায়িত্বমুক্ত মনে হচ্ছে। স্পর্ধা যা দেখানোর তা তো ক্ষমতাবানরা দেখিয়েছে, আমরা তো দেখাইনি। আমরা তো আম মুসলমান। রাষ্ট্র-বিচার-আইন-শাসন ওসব তো আর আমার হাতে ছিল না। না, বন্ধু। আমি আপনি এই ব্যবস্থাকে টিকিয়ে রেখেছি গত একশ' বছর। নিজের মতামত, ভোট, মেধা, অস্ত্র, শ্রম দিয়ে আল্লাহর সাথে স্পর্ধাকারী সিস্টেমকে সমর্থন দিয়েছি। আমরা মনে করেছি, বিশ্বাস করেছি 'রাজনীতিতে আল্লাহর কোন জায়গা নেই'। এই আপ্তবাক্যকে আউড়েছি, শিখিয়েছি, দম্ভভরে ঘোষণা করেছি। কতবড় সাহস আমার, আমি আল্লাহকে বের করে দেবার কথা বলেছি, আল্লাহর দেয়া মাটির উপর দাঁড়িয়ে, আল্লাহ খেয়ে আল্লাহর পরে। আপনারা কী ভাবতে পারছেন আমরা কী করেছি? What we have done? 'আল্লাহ'মুক্ত রাজনীতি করেছি গত একশো বছর। কী জানি কাকে দেখানোর জন্য, কাদের সাপোর্ট পেতে পেছনে ছুঁড়ে ফেলেছি কুরআনের অকাট্য সব বিধান। যেন এসব কুরআনে নেই।
চাকরি জীবনে আল্লাহ-কে বের করে দিয়ে চাকরি খুঁজেছি। চাকরি-তে আবার আল্লাহ কেন আসবে। জীবিকা নিয়ে আল্লাহ কী বললো, তাঁর নবী কী বললো, কোনো তোয়াক্কা করিনি। কেউ বলে দিলেও পাত্তা নেই আমার কাছে। ওসব কী এযুগে চলে? যেন বললাম 'মধ্যযুগীয় আল্লাহ' আর তাঁর 'মধ্যযুগীয় রাসূল' এর কথায় এই আধুনিক যুগ চলবে? এটাই তো বলতে চাই, না কি? কথা ও চিন্তার গতিপথ কোনদিকে দেখেন? আমাদের কথা আর আমাদের কাজে কী পরিমাণ স্পর্ধা প্রকাশ পায়, দেখেছেন? এগুলোর মানে কী দাঁড়ায়? সহীহ মুসলিমের অকাট্য হাদিসে রয়েছে, আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সুদগ্রহীতা, সুদদাতা, সুদের চুক্তিলেখক ও চুক্তির সাক্ষীদের উপর লানত করেছেন, এবং বলেছেন এরা সবাই সমান। নবীজীর লানতের কী মূল্য? ফুঃ ওসব শুনলে জীবন চলে? আলহামদুলিল্লাহ, আজ সুদের চুক্তিলেখকের চাকরি পেয়েছি। মেয়ে জামাই কী করে? জামাই সুদের চুক্তিলেখক। মেয়ে মাইক্রোসুদ এনজিও-তে চাকরি করে। একবারও তোয়াক্কা করিনি আল্লাহ কী বলেছেন এই চাকরির ব্যাপারে। এই পোস্ট পড়তে পড়তে নিজের অন্তরের দিকে তাকান। আল্লাহর যুদ্ধ ঘোষণার কোনো পাত্তা আমার কাছে আছে কি না।
দারিদ্র্যের ভয়ে সুদে ঋণ নিয়েছি, ব্যবসা করব। কে ঘুচাবে আমার দারিদ্র্য? কে বণ্টন করে রিযিক? আমি কি আল্লাহর সাথে যুদ্ধ করে রিযিক ছিনিয়ে আনতে চাচ্ছি? আল্লাহ বলছেন কুরআনে: "আল্লাহ সুদকে হারাম করেছেন... এরপর যদি সুদ ত্যাগ না কর, তাহলে আল্লাহর পক্ষ থেকে 'যুদ্ধের' ঘোষণা শুনে নাও"। হোয়াট? আমরা চাকরি-ব্যবসা করছি, নাকি আল্লাহর সাথে যুদ্ধ করছি? আমরা করতে চাচ্ছিটা কী আসলে? একটু ভাবেন ভাই, আমার পরিচয়টা কী আসলে? মুসলিম? মুসলিম মানে তো আত্মসমর্পিত, এর অর্থ তো 'প্রতিপক্ষ' নয়। আমার ক্যারিয়ার থেকে (৮ ঘণ্টা দিনে) মহাশক্তিধর আমার Owner-কে আমি বের করে দেবার দুঃসাহস দেখিয়েছি। হোম লোন, কার লোন, বিয়ে লোন, শিক্ষা লোন। হে মহাশক্তিধর পরাক্রান্ত আল্লাহর প্রতিপক্ষ, ক্ষান্ত দেন, ক্ষান্ত দেন। নিজের উপর রহম করেন। আল্লাহর ক্রোধকে চিনে নেন।
সূরা মায়িদায় তিনটি পর পর আয়াতে আমাদের Owner, আমাদের যিনি বানিয়েছেন সেই আল্লাহ বলছেন: 'আল্লাহ যা নাযিল করেছেন, তা অনুসারে যে বিচারকার্য করে না...' প্রথমে বলছেন 'ওয়া হুম কাফিরুন' (সে কাফির), পরের আয়াতে বলছেন 'ওয়া হুম জলিমুন' (সে জালেম, অত্যাচারী)। পরের আয়াতে বলছেন: 'ওয়া হুম ফাসিকুন (গর্হিত পাপাচারী)। আল্লাহর এই কথাগুলোর আর কোনো ব্যাখ্যা দরকার আছে?
ভার্সিটিতে সাবজেক্ট চয়েসের সময়, সার্ভিস কমিশনে পরীক্ষা দেবার সময়, একবারের জন্যও মন বলেনি আমার Owner কী বলেছেন দেখি। এই সাবজেক্টটা নিব, না নিব না। এই চাকরিটা করব, না করবো না। আমার জীবনে আমার আল্লাহর মতামতের কী মূল্য আমি দিয়েছি? বলেন, কী মূল্য আমার কাছে সর্বশক্তিমান শাস্তিদাতা এবং একইসাথে স্নেহশীল অভিভাবক Owner আল্লাহর। আমার চাকরিই আজ আল্লাহ-বিরোধী আইন প্রয়োগের। আমার শক্তি-মেধা-শ্রম-অস্ত্র দিয়ে আমি আল্লাহ-বিরোধী আইনকে টিকিয়ে রেখেছি। উঁচু থেকে উঁচু পদে উন্নীত হয়েছি। হে মুসলিম ভাই, আমরা কি মুসলিম আছি? নাকি আল্লাহর প্রতিপক্ষ হয়ে গেছি। এর পরের প্রোমোশন তো 'ওয়া হুম কাফিরুন-জলিমুন-ফাসিকুন' (কাফির-জালিম-ফাসিক)। আল্লাহ বলছেন: এখনও কি ঈমানওয়ালাদের সময় আসেনি অন্তর বিগলিত হবার? নিজেই বিচার করেন, এই লেখা পড়ার পর আপনার অন্তর কি বিগলিত, না কি উদ্ধত? কোনো ব্যাখ্যা দিলাম না, বলবেন অপব্যাখ্যা করছি। জাস্ট কুরআন কোট করলাম।
ফেসবুকে ডাক্তারদের বেশকিছু গ্রুপ আছে। ডাক্তাররা জানে ঔষধের সাথে পথ্য (সহযোগী খাবার) দেয়া হয়। এরপরও আমি নিশ্চিত জানি, পথ্য হিসেবে মধু ও কালোজিরার আয়াত ও হাদিসগুলো সেখানে দিলে হিন্দু ও মুরতাদরা 'হা হা' রিয়্যাক্টে ভরিয়ে দেবে। অথচ আদা-রসুন-ছাগলের দুধ, হলুদের কথা বললে দিতো না। সেটা সমস্যা নয়। সমস্যা হল, বহু মুসলিম দাবিদার, এমনকি নামাযী-হিজাবীরাও হাহা দেবে। অনেকে বলবে, কোনো 'মোল্লাদের গ্রুপে' দিতে, এখানে ধর্মীয় আলাপ না করতে। এই বিভাজনটা কীভাবে এলো? কে আমাদেরকে বলে দিল: সব আলাদা করে ফেল, এগুলো থেকে আল্লাহকে আউট করে দাও। আল্লাহর নাম নিবা শুধু মসজিদে-মাদরাসায়। মসজিদ থেকে বেরিয়ে প্যান্ট ভাঁজ খুলে ফেলবা, ভুলে যাবা আল্লাহ নামে কেউ আছে। মসজিদের ভিতরে করো ঠিক আছে, বাইরে তাঁর আর এখতিয়ার নেই। জীবনের ক্ষেত্রগুলো আলাদা করে দেয়া, সবখানে ধর্ম টেনে আনবেন না-এসব শ্লোগান তো মুসলিমের মত শোনায় না। তাহলে আল্লাহ যে দণ্ডবিধি দিলেন, তার উপর আমাদের ঈমান কোথায়। আল্লাহ যে অর্থব্যবস্থা দিলেন তার উপর ঈমান কোথায়। তাহলে কী আমরা কুরআনের কিছু অংশ মানি, কিছু মানি না? আল্লাহ যে পরিবার ব্যবস্থা দিলেন, তার উপর ঈমান কোথায় আমার?
আমরা তো মুসলিম ছিলাম। আল্লাহর উপর ঈমান এনেছিলাম। আমাদের তো সবখানেই আল্লাহ ছিলেন। অফিসে, আদালতে, ব্যবসায়, অর্থব্যবস্থায়, বিচার, শিক্ষায়। তখন জবাবদিহিতা ছিল, দুর্নীতি-ঘুষ-আত্মসাৎ আল্লাহর উপস্থিতির স্মরণে ভয়ে কল্পনাতেও আসতে পারত না। সে অবস্থায়ই তো আমরা সব সভ্যতার শীর্ষে ছিলাম। হীরা শহর থেকে মদীনা ১২০০ মাইল একজন নারী একেলা উটে চড়ে এসেছে (এভাবে ভ্রমণ শরীয়াহসম্মত নয়), কেউ তার দিকে চোখ তুলে তাকায়নি সেসময়। স্বয়ং খলীফার বিরুদ্ধে বিচার হয়েছে, রায় গেছে সংখ্যালঘু ইহুদীর পক্ষে। এ কেমন আইন, এ কেমন সিস্টেম, এ কেমন অফিস, এ কেমন বাজার। ইহুদী আসামী মুসলিম হয়ে গেছে। কাফির ইসলাম গ্রহণ করেছে সিস্টেম 'দেখে', যাকে যুক্তি দিয়ে খণ্ডন করে বুঝাতে পারতেন না, সে নিজচোখে দেখে বুঝে গেছে। আজ আমরা দেখাতে পারছি না। শরীয়া সবচেয়ে বড় দাওয়াত। সুখ-সমৃদ্ধি-নিরাপত্তা-ইনসাফ-আইনের শাসন-অধিকার-জ্ঞানবিজ্ঞান এর চূড়ান্ত রূপ তো আমরা দেখেছিলাম আল্লাহর আইনের অধীনেই। তাহলে কীসে আমাকে বাধ্য করল আল্লাহকে পরিত্যাগ করতে? "হে মানুষ! কী তোমাকে ধোঁকা দিল, যে তুমি তোমার বদান্য রব্বকে পরিত্যাগ করলে?" (আয়াত)
আমার আজ প্রচুর টাকা দরকার, সমাজে সম্মান দরকার, উঁচু পদ দরকার। যেকোনো মূল্যে, যেকোনো কিছুর বিনিময়ে। প্রয়োজনে আল্লাহর বিরুদ্ধে গিয়ে, আল্লাহর সাথে যুদ্ধ করে, আল্লাহ-বিরোধী এই সিস্টেমটার প্রহরী হয়ে। অথচ আমি দুনিয়াতে আসার উদ্দেশ্য ছিল যেকোনো মূল্যে আল্লাহকে খুশি করা, যেকোনো কিছুর বিপরীতে আল্লাহর দাসত্ব করা। "আমি জীন ও মানুষ সৃজন করেছি কেবলমাত্র আমার দাসত্বের জন্য" (আয়াত)। এই উপর্যুপরি অবাধ্যতা, বিদ্রোহ আর গুনাহের উপর অটলতা আমাকে 'দাস' (বান্দা) হয়ে কবরে যেতে দেবে তো? নাকি তাঁর 'প্রতিপক্ষ' হয়ে যাব কবরে? বিশ্বাস করেন, আমার লোম দাঁড়িয়ে যাচ্ছে। রিযিকের জন্য আজ আল-রাজ্জাকের বিরুদ্ধে আমি? ইজ্জতের জন্য আজ আল-মুইজ্জের বিরুদ্ধে আমি? কে আমি? আজ আমার এতো শক্তি, এতো সাহস? আল্লাহ ক্রোধের উপযুক্ত আমি ছাড়া আর কে?
চলবে ইনশাআল্লাহ