ভার্সিটির লাইফ, বিশেষ করে হল লাইফটা মন্দ ছিলনা নাবিলের । ফেসবুকিং করার ফাঁকে ফাঁকে ক্লাস করা, ক্লাসে বসে ঝিমানো, শর্টপিচ ক্রিকেটে চিতার ক্ষিপ্রতায় ফিল্ডিং করা, মসজিদের বারন্দায় বসে ঘন্টার পর ঘন্টা আড্ডা দেওয়া। কোন চিন্তা নেই কোন ভাবনা নেই, দুনিয়া উলটে যাক তাতে নাবিলের কী… শুধু চিল আর চিল।
বাবা-মার নজরদারি যেহেতু ছিলনা কাজেই ছোটবেলা থেকে মেনে আসা সান্ধ্য আইনের থোড়াই কেয়ার করে ইচ্ছেমতো রাত বিরাতে ঘুরে বেড়ানো যেত। কতো গভীর হাওয়ার রাত পামগাছের তলায় বসে কাটিয়ে দিয়েছে সে। মন্ত্রমুগ্ধের মতো রূপালী চাঁদের দিকে তাকিয়ে থেকেছে। সবুজ ঘাসের বুকে শুয়ে পার করে দিয়েছে অজস্র বৈশাখী বিকেল।
সবকিছুরই শেষ আছে। একদিন রূপকথা শেষ হয়ে গেল। স্বপ্নভঙ্গ হল। বের হতে হল পৃথিবীর নির্দয় পথে। সময়ের কাছে মানুষ বড় অসহায়।
পৃথিবীর রূঢ় রৌদ্রে প্রতিনিয়ত দগ্ধ হতে হতে, নানা সাইজের নানা গুতো খেতে খেতে নাবিল ঠিক বুঝে গেল কতো ধানে কতো চাল- হাউ ম্যানি রাইস ইন হাউ ম্যানি প্যাডি। রৌদ্রাহত, গুতো খাওয়া,টালমাটাল হৃদয় শান্তি খুঁজে বেড়ায়। শান্তি … দুদন্ড শান্তি।
চৈত্রের বিকেলে অশত্থ গাছের পাতায় বাতাসের দাপাদাপি আর কাকের চোখের মতো টলটলে স্বচ্ছ দিঘীর পানির মতো শান্তি। ভাদ্রের ভ্যাঁপসা গরম, শহর পঁচে গেছে। রাজপথে জট লেগেছে লোকাল বাস, সিএনজি, রিকশা। ঘড়ির কাটা দুর্বল হয়ে গিয়েছে। দরদর করে ঘামছে মানুষ। তারপর হঠাৎ করেই একে একে আসলো অতিথিরা। প্রথমে সুসংবাদবাহী বাতাস, তারপর কালো মেঘ, তারপর বৃষ্টি। অঝোর বৃষ্টি। কান্নার মতো বৃষ্টি। শান্তির বৃষ্টি।
বাংলাদেশের জাতীয় রোগে আক্রান্ত হয়ে গেল নাবিল। কিছুই ভালো লাগেনা। কিছুই না। সবকিছু ভাংচুর করতে ইচ্ছে করে।
কলিংবেল টিপে অপেক্ষা করা বড় কষ্টের। দরজা খুলেই দুষ্টু ছোটভাইয়ের ওরাংওটাঙের মতো চেহারা দেখা আরো কষ্টের। নাবিলের একজোড়া কালো চোখ দরকার, দরজা খুললেই যেটা নাবিলকে প্রশান্তি দিবে। একজোড়া লতানো হাত দরকার। দুঃখের প্রহরে যে জড়িয়ে ধরে উষ্ণতা জোগাবে। তেলাপোকা দেখে ভয় পেয়ে কেউ একজন দৌড়ে আশ্রয় খুঁজুক নাবিলের কাছে, রাস্তা পার হবার সময় নাবিলের বাম বাহুটা আঁকড়ে ধরুক পরম নির্ভরতা আর নিশ্চিন্ততায়।
খুব বেশি কিছুনা, দুআঙ্গুলের ডগায় যতোটুকু লবন আটকে নাবিল ঠিক ততোটুকু ভালোবাসা চায়। বন্ড সই করে হলেও সামান্য হৃদয়ের ঋণ চায়।
চারপাশে ভালোবাসার জোয়ারে ভেসে যাওয়া মানুষদের দেখে নাবিলের বড় মন খারাপ হয়। কতো কষ্টে নিজেকে সামলিয়ে রাখে। কায়মনোবাক্যে দু’আ করে আল্লাহ্র কাছে।
দু’আ আর অষ্টপ্রহরের মাঝে অচেনা তুমি এক দূরতরো দ্বীপ হয়েই রইলে । আমার দুরু দুরু বুক, ছেঁড়া পাল, গোলমেলে ক্যাম্পাস। ছোঁয়া হলোনা তোমাকে’- সে ভাবে।
আল্লাহ (সুবঃ) মানুষকে বানিয়েছেনই এভাবে যে যখন সে বালেগ হবে তখন একজন সঙ্গী বা সঙ্গিনীর জন্য তার মন আঁকুপাঁকু করবে। সংগীহীনতায়, একাকীত্বে অন্তরে হাহাকার করে উঠবে। যদি এই হাহাকার দূর করার ব্যবস্থা না নেওয়া হয় তাহলে তা একসময় ধ্বংস আর পতনের আহ্বানে পরিণত হবে। এই একাকীত্ব, এই অভাববোধ, শরীরের ক্ষুধা মেটানোর এই সমস্যার সহজ সমাধান দিয়ে দিয়েছেন আল্লাহ (সুবঃ) – বিয়ে। বাবা-মা’দের আদেশ করেছেন যখন ছেলেমেয়েরা বালেগ হয়ে যাবে তখন তাদের বিয়ের ব্যবস্থা করে দিতে। বিয়েকে সহজ করতে বলা হয়েছে। যতো বেশি সহজ করা যায়। যেন সমাজের ভারসাম্য বজায় থাকে। উন্নতি আর প্রগতির কক্ষপথ থেকে সমাজ বিচ্যুত না হয়ে পড়ে।
মদীনা সনদে চলা দেশে (!), ধর্মপ্রাণ মুসল্লিদের (!) এই সমাজ এই সহজ সমীকরণ বোঝেনা। এই সভ্যতা, এই সমাজ কতোকিছু বুঝে ফেললো নিমিষেই,বুঝে ফেললো রকেট সায়েন্স, নিউট্রণ বোমা। বুঝলোনা শুধু মানুষের মৌলিক চাহিদাগুলোকে। বুঝলোনা একজন তরুণ কী চায়। মানুষের সহজাত ফিতরাতকে চোখ বুঝে জোর করে অস্বীকার করে ফেলল এই সমাজ। আগাগোড়া পুরো সংজ্ঞাটাই বদলে দিল।
যতোবেশিভাবে করা সম্ভব বিয়েকে কঠিন করে দেওয়া হল। অদ্ভূত অদ্ভূত হাস্যকর কিন্তু কঠিন সব শর্ত জুড়ে দেওয়া হল। বিয়ে করতে হলে আগে বড় হতে হবে। কতো বড়? তার কোনো লিমিট নেই। শুধু চাকুরী থাকলেই হবে না সরকারী চাকুরী থাকতে হবে, যেন মানুষকে বড় মুখে বলা যায়, ৪০-৫০ হাজার স্যালারি পেতে হবে মাস মাস, বাড়ি থাকতে হবে গাড়ি থাকতে হবে, লাখ লাখ টাকা দেনমোহর দিতে হবে- মেয়ে গাংগের জলে ভেসে এসেছে নাকি?
মেরুদন্ড ভাংগা শিক্ষাব্যবস্থা ২৭-২৮ বছর ধরে ছেলেমেয়েদের ক্লাসরুমে আটকিয়ে রাখে। বের হলেও নিস্তার নেই। চাকুরী সোনার হরিণ। মামা খালু চাচা থাকা ,সঠিক দলের লোক হওয়া আর বস্তা ভর্তি টাকা না থাকলে জীবন যৌবন ব্যায় করে অর্জন করা সার্টিফিকেটের কোনো দামই নেই। বয়স ৩০ এর কোঠা পার হয়ে যায়, মেঘে মেঘে অনেক বেলা হয়ে যায় কিন্তু বিয়ের যোগ্যতা অর্জন করা আর হয়ে ওঠেনা।
কোটি কোটি বেকার ছেলেমেয়ে চরম হতাশায় দিন কাটায়। মাদকে ডুবে নিজের দুঃখ কষ্ট ভুলতে চায়। কেউ কেউ বেছে নেয় আত্মহননের পথ।
সমাজ না বুঝুক, চোখ বুজে অস্বীকার করুক, এই ছেলেমেয়েদের শরীরে তো যৌবনের ফাগুন আসেই। হালাল উপায়ে ক্ষুধা মেটানোর তো কোনো ব্যবস্থায় নেই। অন্যদিকে হারামের পথ অত্যন্ত সহজ। এই ছেলেমেয়েগুলো কী করবে? কেউই এদের কথা ভাবেনা। এদেরকে আমরা কেন নির্বাসন দিয়ে রেখেছি? এদের কেন ভুলে গিয়েছি?
ক্ষুধার্ত ছেলেমেয়েদের সামনে থেকে সমাজ যদি খাবার সরিয়ে রাখতো,বা আড়াল করে রাখতো তাহলে ছেলেমেয়েদের কষ্ট কিছুটা কম হতো। নিজেকে সংবরণ করে রাখতে কিছুটা কষ্ট কম হতো। কিন্তু সর্বগ্রাসী বিষাক্ত অশ্লীল বাতাসে প্রকম্পিত এই সভ্যতা। বড় বেশি লোভ,বড় বেশি বিজ্ঞাপন, বড় বেশি চাহিদা- কাম আর লালসার। চতুর্দিকে ভালোবাসার বড্ডো আকাল। নারী স্বাধীনতার নামে নারীকে এখানে শুধু পণ্যে (আইটেম) পরিণত করা। নারী যেন শুধু আমোদ ফুর্তি করার জমাট একটা মাংসপিন্ড।
প্রথম আলো অশ্লীল ছবির অভিনেতা অভিনেত্রীদের ঘরের মানুষ বানিয়ে ছাড়লো, নকশা, অধুনা শিখিয়ে দিল কীভাবে পোশাক পরলে যৌবন জ্বালায় অস্থির ছেলেদের হাতের আংগুলে খেলানো যাবে। ক্লোজআপ কাছে আসার গল্প শেখালো, সারোয়ার ফারুকী ভাই বেরাদর মিলে লিটনের ফ্ল্যাট চেনালো। আইটেম সং, বিজ্ঞাপন, মুভি সিরিয়াল, নাটক, ইউটিউবের মিউজিক ভিডিও,সালমান মুক্তাদির গং, ট্রল পেইজ-গ্রুপ, ফেইসবুক লাইভ, বিলবোর্ড, বিপিএল সব কিছু, সব কিছু তরুণদের উস্কানি দেয়। অবদমিত যৌবনকে ছারখার করে দেয় কামের আগুনে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে।
এই জেনারেশনের কষ্ট,টানপোড়েন বোধহয় আগের জেনারেশন কখনোই বুঝতে পারবেনা। আসলে ওদের কোনো দোষ নেই। কষ্টগুলো এতোটাই তীব্র, পরীক্ষাগুলো এতোটাই কঠিন যারা এগুলোর মুখোমুখি হননি তাদের পক্ষে কষ্টের তীব্রতা অনুভব করা অত্যন্ত কঠিন।
কয়জন শখ করে রিকশায় লুইচ্চামি করে? লিটনের ফ্ল্যাটে যায়? যারা যায় সব দোষ কী একা তাদেরই? সমাজের কোনো দোষ নেই? এই ছেলেমেয়েগুলোর দিকে আংগুল তোলার আগে আমাদের নিজেদের দশবার চিন্তা করা উচিত। আমরা তরুণ তরুণীদের দিনের পর দিন ক্ষুধার্ত রেখেছি, ক্ষুধার্তদের সামনে আকর্ষনীয়ভাবে লোভনীয় লোভনীয় সব খাবার উপস্থাপন করেছি আর হালাল উপায়ে সে খাবার খাবার সব উপায় দুর্গম গিরি কান্তারের মতো করে রেখেছি। হারামকে করে রেখেছি একদম সহজ। এখন তরুণ তরুনীরা যদি পাপে জড়ায়, জিনা ব্যাভিচার করে তার দোষ যেমন তাদের ঠিক তেমনি এই সমাজের মানুষগুলোরও।
এস্টাব্লিশডমেন্ট, সোস্যাল স্ট্যাটাস, লাখ লাখ টাকার দেনমোহর, লৌকিকতা, ওয়েডিং ফটোগ্রাফি, সঙ্গীত সন্ধ্যা, হলদি নাইটসের বেড়াজাল ডিংগিয়ে তরুণ-তরূনীদের প্রতি ভালোবাসা আবার কবে ফিরে আসবে মানুষের হৃদয়ে হৃদয়ে? কবে ভালোবাসা পাবে ভালো রেসাল্ট করেও সিস্টেমের দোষে বেকার বসে থাকা লাখ লাখ যুবক? কবে ভালোবাসা পাবে নিজের চরিত্র রক্ষায় ছাত্র থাকা অবস্থাতেই বিয়ে করতে চাওয়া তরুণ?
পুরোনো রঙিন সেই শৈশবের দিনগুলোতে হা হুতাশ করত নাবিল- কবে বড় হবে, কবে স্বাধীনতা পাবে! ভাবতো জীবনের সব সুখ, সব আনন্দ,সব স্বাধীনতা সবই বোধহয় সুদূরের এই বয়সটাতে। বহু আকাঙ্ক্ষিত এই বয়সটাতে এসে অবাক হয়ে আবিষ্কার করলো সব সুখ,সব আনন্দ শৈশবে ফিরে গিয়ে ভেংচি কাটছে।
আবার শিশু হতে ইচ্ছে করে। ইচ্ছে করে পরাধীন হতে, টেনিস বলে টেপ পেঁচিয়ে অদ্ভূত অদ্ভূত সব আইন বানিয়ে শর্ট পিচ খেলতে , মাগরিবের আযান শোনামাত্র খেলা ফেলে তড়িঘড়ি করে বাসায় ফিরে যেতে। এক টাকার নারিকেল দেওয়া বরফ খেতে।
আবার বাবা হাত বাড়িয়ে দেবেন। নাবিল তাঁর কনিষ্ঠ আঙ্গুল শক্ত করে ধরে রাখবে। মানুষের ভীড়ে নাবিল আর হারিয়ে যেতে চায়না।
ঈশ! আবার যদি ফিরে পেতাম শৈশবের সেই পবিত্র দিনগুলো। যখন বুনো হলুদ ফুলের মতো নরম স্নিগ্ধ ছিল হৃদয়, এখনকার মতো দাউ দাউ আগুন জ্বলতোনা অষ্টপ্রহর- নাবিল আফসোস করে।
ব্যালকনির আলোর দীর্ঘ ছায়া এসে পড়ে অন্ধকার ঘরে। নারিকেলের পাতায় আছড়ে পড়ে ভেজা বাতাস। মাঝে মাঝে পথ ভুলে ঢুকে পড়ে ঘরে। ছুঁয়ে যায় আলো আর অন্ধকার, আশা আর নিরাশা।
নাবিল এক নব্য প্রাচীন যুবক। বিছানায় শুয়ে ছটফট করে।
সমীকরণ ধীরে ধীরে জটিল হতে থাকে। যোগ হতে থাকে একের পর এক নতুন ভ্যারিয়েবল। সমাধান করবে কে? আদৌ কি সমাধান আছে না সমাধান অনির্ণীত?
আল্লাহ্ সুবহানু তা’আলা কোন সমস্যা সৃষ্টি করেছেন আর তার সমাধান দেননি এমনতো হতে পারেনা । তিনি কখনোই মানুষের ওপর জুলুম করেননা ।
মানুষের প্রতি দয়া করাকে তিনি নিজের কর্তব্য হিসেবে স্থির করেছেন। মানুষের প্রতি তিনি অত্যন্ত দয়াশীল।
তিনিই তালা সৃষ্টি করেছেন আবার সেই তিনিই তো চাবি সৃষ্টি করেছেন।
আধার যতোই ঘনকালো হোকনা কেন আলোর দেখাতো এক সময় মেলেই।
এই সিরিজে আমরা ইনশা আল্লাহ চেষ্টা করব বিয়ে নিয়ে তরুণদের মধ্যে প্রচলিত ভুল ধারণা দূর করার। কীভাবে বাবা মাকে বোঝাতে হবে, কীভাবেই বা বিয়ের জন্য আর্থিক সামর্থ্য অর্জন করতে হবে সেই বিষয়গুলোকে কেন্দ্র করেই আবর্তিত হবে আমাদের আলোচনা।
ইনশা আল্লাহ।