আজ থেকে চার বছর আগে Colin Kaepernick নামের একজন কৃষ্ণাঙ্গ খেলোয়াড় আমেরিকান ন্যাশনাল ফুটবল লীগের (NFL) ম্যাচে জাতীয় সঙ্গীত চলাকালীন হাঁটু গেড়ে বসে প্রতিবাদ জানিয়েছিল। সে বলেছিল, যে দেশ কালো মানুষের প্রতি অত্যাচার করে, বর্ণবাদী আচরণ করে, সে দেশের জাতীয় সঙ্গীতের সম্মানে সে দাঁড়াতে পারবে না। এরপর তাকে অনেক চড়াই উতরাই পার হতে হয়। তাকে ক্লাব ছাড়তে হয়, এরপর আর কোনো ক্লাব তাকে দলে নেয়নি। NFL এ হাঁটু গেড়ে প্রতিবাদ করা নিষিদ্ধ করা হয়, কেউ করলে জরিমানার আইন করা হয়। ডোনাল্ড ট্রাম্প Colin Kaepernick এর কড়া সমালোচনা করেন। তার জন্য উপযুক্ত, এমন কোনো দেশ খুঁজে নিতে বলা হয়। কিন্তু এরপরও Colin Kaepernick দমে যায়নি। ঐ ঘটনার পর কোনো দল তাকে না নেওয়ায় সে আদালতে মামলা করে।
চার বছর পর, Colin Kaepernick এর সেই হাঁটু গেড়ে প্রতিবাদ স্টাইল সারা বিশ্বে এখন ট্রেন্ড হয়ে গেছে। সেলিব্রেটি থেকে দেশে দেশে রাজনৈতিক নেতা, প্রধানমন্ত্রী পর্যন্ত হাঁটু গেড়ে প্রতিবাদ জানাচ্ছেন। কিন্তু "ট্রেন্ড" হয়ে উঠার আগ পর্যন্ত এই কাজটির জন্য একজন মানুষকে অনেক মাশুল গুণতে হয়েছে। অনেক স্যাকরিফাইস করতে হয়েছে। একা নিজেকে স্রোতের বিপরীতে দাঁড়াতে হয়েছে।
ইতিহাসের পাতা খুলে ১৪০০ বছর আগে ফিরে দেখুন, এমনটাই হয়েছিল। আজকে আমরা ধর্ম হিসেবে যে ইসলামকে জানি, সত্যি বলতে আমাদের কারোরই এর জন্য কোনো এফোর্ড দিতে হয়নি। কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া আমরা প্রায় সবাই-ই এটা উত্তরাধিকার সূত্রে পেয়েছি। কিন্তু যে মানুষটা প্রথম এই দ্বীনের বার্তা নিয়ে আসেন, তাঁর জন্য এবং তাঁর সাথীদের জন্য এটা মোটেই সহজ কিছু ছিল না। এই দ্বীনের জন্য তাদেরকে জীবন দিতে হয়েছে, অত্যাচারিত হতে হয়েছে, বাড়িঘর ছাড়তে হয়েছে, ক্ষুধার জ্বালায় পেটে পাথর বেঁধে থাকতে হয়েছে, নিজের আপনজনদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে হয়েছে। অনেক চড়াই উতরাই পেরিয়ে, কত শত জমিন নিজেদের রক্তে রাঙিয়ে, কত প্রিয়জন, প্রিয় বস্তু বিসর্জন দিয়ে আজকের এই দ্বীন ইসলামের ভীত গড়ে উঠেছে!
এজন্য প্রথম প্রজন্মের মুসলিমরা, মানে সাহাবীরা ইসলামে অন্য মর্যাদায় সমাসীন। তাদের মধ্য থেকে ১০ জনকে দুনিয়াতে থাকতেই অগ্রীম জান্নাতের সুসংবাদ দেওয়া হয়েছে। আল্লাহর ঘর, নিজের শহর মক্কা ছেড়ে রাসূল (সা.) জীবনের শেষ দিনগুলো আনসারদের সাথে ছিলেন, এমনকি মৃত্যুর সময় বারবার তিনি সাহাবীদের বলেছেন, আনসারদের সাথে যেন ভালো আচরণ করা হয়। কেন? কারণ এই আনসাররাই ছিলেন দ্বীনের আনসার, এই দ্বীন যখন শুরুর সময়ে অত্যাচারিত, নির্যাতিত তখন এই আনসাররাই তাকে আশ্রয় দিয়েছে, এই দ্বীনের হয়ে যুদ্ধ করেছে, কোনো ধরনের দুনিয়াবি স্বার্থ ছাড়াই, শুধুমাত্র আখিরাতের আশায়। যে কারণে রাসূল (সা.) আনসারদের কদর করেছেন, তাদের সাথেই জীবনের শেষ দিনগুলো কাটিয়েছেন।
কোনো কিছুর জন্য যখন লোকপ্রিয়তা লাভ করে, মানুষের কাছে ব্যাপকভাবে গ্রহণযোগ্য হয়ে যায়, তখন তার পক্ষে দাঁড়ানো সহজ, মানুষ দলে দলে তার পক্ষ নেয়। আল্লাহ কুরআনে বলেছেন,
"যখন আসবে আল্লাহর সাহায্য ও বিজয় এবং আপনি মানুষকে দলে দলে আল্লাহর দ্বীনে প্রবেশ করতে দেখবেন।" [১১০: ১-২]
আমেরিকায় জর্জ ফ্লয়েডের মৃত্যুর পর এখন সবাই কালোদের পক্ষে, বর্ণবাদের বিরুদ্ধে কথা বলছে। যে NFL হাঁটু গেড়ে প্রতিবাদ করা নিষিদ্ধ করেছিল তারা ক্ষমা চেয়ে বলেছে, এটা তাদের ভুল ছিল। চলমান এই আন্দোলনের সাথে একাত্মতা জানিয়েছে ইংলিশ ফুটবল ক্লাব আর্সেনাল, অথচ তাদের একজন খেলোয়াড় মেসুত ওজিল যখন উইঘুরদের উপর চীনের দমন পীড়নের বিরুদ্ধে কথা বলেছিল, আর্সেনাল সাথে সাথে স্টেটমেন্ট দিয়েছিল, এটা ওজিলের ব্যক্তিগত মত, এর সাথে ক্লাবের কোনো সম্পর্ক নেই। কারণ উইঘুরদের বিরুদ্ধে অত্যাচার বিশ্বব্যাপী "ট্রেন্ড" হতে পারেনি। এটা স্রোতের বিপরীতের ইস্যু। এর পক্ষে দাঁড়াতে গেলে মূল্য দিতে হয়।
ভারতের দিল্লীতে কয়দিন আগে দিনে দুপুরে দল বেঁধে মুসলিম কাউকে দেখলেই পিটিয়ে মারার যে উৎসব চলেছে, তার হৃদয়স্পর্শী সব ছবি মিডিয়াতে আসার পরও ভারতের সেলিব্রেটিরা মুখে কুলুপ এঁটে ছিল। তারা এখন খুব বর্ণবাদবিরোধী, সাম্প্রদায়িকতা বিরোধীতার সবক দিচ্ছে।
একই কথা দ্বীনের ক্ষেত্রেও। এখানেও সবাই ট্রেন্ডি ইসলামটাই চায়। যেখানে সবাই খুশি থাকবে। "মানুষ কী বলবে"—এই কনসার্ন থাকবে। দ্বীনের যে বিষয়গুলো নিজের প্রবৃত্তি, সমাজ, "মানুষ কী বলবে" এই ফিল্টারে আটকে যাচ্ছে, সেখানে "ইসলাম এত কঠিন না" মর্মে নিজেকে সান্ত্বনা দিয়ে চলবে।
ট্রেন্ড ফলো করার মধ্যে কোনো বিশেষ কৃতিত্ব নেই। স্রোতে গা ভাসিয়ে দিলে, স্রোত আপনাতেই ভাসিয়ে নিয়ে যায়, এটা সবাই পারে। কিন্তু সত্যের পক্ষে সিনা টান করে দাঁড়ানো, কঠিন স্রোতের বিপরীতে উল্টো দিকে যাত্রা করা, সিস্টেমকে চ্যালেঞ্জ করা, এটা সবাই পারে না। কারণ এটা করতে গেলে কিছু মূল্য দিতে হয়। কম্পোর্ট জোন থেকে বের হতে হয়। এই স্যাকরিফাইসটুকু কিছু মানুষ করে বলেই পৃথিবীতে সত্য আজো টিকে আছে। কিয়ামত পর্যন্ত থাকবে।