বাগানবাড়ীতে মধুরঙ্গা সন্ধ্যার শেষে রাত সমেমাত্র শুরু হতে যাচ্ছে। সঙ্গিত ও সূরার আসর এরমধ্যেই জমে গেছে বেশ। খোদ বাগানবাড়ীর মালিকই যখন সঙ্গিত ও শরাবের বিদগ্ধ সমঝদার, মজলিশ রওনক ও রঙ্গিন হতে আর দেরী লাগে! ক্রমেই সুর ও সূরায় পুরো আসর বুঁদ হয়ে পড়ে। গাইতে গাইতে এক সময় বাগানবাড়ীর মালিকের চোখ নেশার আবেশে মুদে আসে। তন্দ্রাচ্ছন্ন ভাব কেটে যাবার পরক্ষণেই আবার সারঙ্গিটা হাতে নিয়ে ফের বাজাতে উদ্যত হন। কিন্তু বাদ্যযন্ত্রটি সাড়া দিচ্ছে না। একবার, দু’বার। পরীক্ষা করে ফের কোশেশ করলেন। কাজ হলো না। বাদ্যযন্ত্রের তার মেরামত করে তৃতীয়বারের মতো চেষ্টা করলেন। এবার আওয়াজ ভেসে আসল। কিন্তু কোন গানের নয়,
আওয়াজ ভেসে আসলো কুরআনের একটি আয়াতের,-
أَلَمْ يَأْنِ لِلَّذِينَ آَمَنُوا أَنْ تَخْشَعَ قُلُوبُهُمْ لِذِكْرِ اللَّهِ وَمَا نَزَلَ مِنَ الْحَقِّ
‘‘যারা মুমিন, তাদের জন্যে কি আল্লাহর স্মরণে এবং যে সত্য অবর্তীর্ণ হয়েছে, তার কারণে হৃদয় বিগলিত হওয়ার সময় আসেনি?" [সূরা হাদীদঃ আয়াত ১৬]
তৎক্ষণাত গায়ক তার প্রতিউত্তরে বলে উঠলেন,-‘হে রব ! আমার সময় চলে এসেছে।’ সবকিছু ছুড়ে ফেলে দিয়ে সেখান থেকে বের হয়ে চলে আসলেন, চিরদিনের মতো।
শুরু হলো পথচলা একজন আবেদ, মুজাহিদ, মুহাদ্দিসের।
লড়াই চলছে, তুমুল লড়াই। মুসলমান বনাম রোমক সৈন্য। রোম সৈনিকদের কাতার থেকে এক দক্ষ ও বীরযোদ্ধা বেরিয়ে এসে মুসলমানদেরকে দ্বন্দ্বযুদ্ধে আহবান করল। একজন মুজাহিদ ধীরস্থিরভাবে মুসলমানদের কাতার থেকে বেরিয়ে তার মুখোমুখি দাঁড়ালেন, চেহারা তার নেকাবে ঢাকা। প্রায় ঘন্টাব্যাপী তুমুল প্রতিন্দ্বন্দ্বিতার পর মুজাহিদ তাকে হত্যা করলেন। আরো একজন রোমান সৈন্য বেরিয়ে এলো; মুজাহিদ তাকেও হত্যা করলেন। এরপর সেই মুজাহিদই রোমান সৈন্যদেরকে ডুয়েলের জন্য আহবান জানালে আরো একজন রোমান সৈনিক তার ডাকে সাড়া দেয়। তীব্র লড়াইয়ের পর তাকেও হত্যা করেন জামার আস্তিনে মুখ ঢাকা ঐ মুজাহিদ। এই ঘটনার বর্ণনাকারী আবদাহ বিন সুলায়মান বলেন, আমি ঐ মুজাহিদের পরিচয় জানার জন্য তাঁর মুখ থেকে আস্তিন সরিয়ে খুব অবাক হয়ে পড়ি। তিনি সে সময়ের একজন বিখ্যাত মুহাদ্দিস ছিলেন। সেই মুজাহিদ আমাকে তাঁর পরিচয় প্রকাশ না করার জন্য প্রতিশ্রুতিবদ্ধ করেছিলেন।
আবদাহ বিন সুলায়মান রাহ. ইতিহাস রক্ষার স্বার্থে পরবর্তিতে সে প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করেছিলেন। আমাদের সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন একজন ‘মুহাদ্দিস মুজাহিদ’কে।
***
বিখ্যাত তাবেয়ী ফুযাইল বিন আ্ইয়ায রাহ. একবার সে সময়কার একজন বিখ্যাত হাদীসশাস্ত্রবীদকে অনুযোগ করে লিখেছিলেন, আপনি কতোবড় একজন পন্ডিত মানুষ। আপনি জিহাদের ময়দানে বেশী সময় না দিয়ে জ্ঞানচর্চার অঙ্গনে বেশী সময় ব্যয় করলে সবাই অধিক উপকৃত হত। উত্তরে সেই মুহাদ্দিস যেই চিঠিটি লিখেছিলেন, তা ইসলামী ইতিহাসের এক স্বর্ণরেনু হয়ে আভা ছড়াচ্ছে। চিঠিটি শুরু হয়েছিল,-
يا عابدَ الحرمين لو أبصرتْـَنا .. لعلمتَ أنَّكَ في العبادةِ تلعبُ
‘হে হারামাইনের আকন্ঠ নিমগ্ন সাধক! যদি তুমি আমাদের দেখতে – তবে বুঝতে যে ইবাদত নিয়ে এখনো খেলাধুলাই করছো।’
মুহাদ্দিস মুজাহিদের সেই চিঠির উত্তর আজো আমরা দিতে পারি নাই।
***
পুরো আসমাউর রিজাল ও উলূমুল হাদীস শাস্ত্রের ইতিহাসে এমন মুহাদ্দিস বিরল, যাঁর ব্যাপারে কোন তাত্ত্বিক সমালোচনাই হয়নি। প্রায় প্রত্যেকের বিষয়ে খুব অল্প পরিমাণে হলেও, কোন না কোন আলোচনা, সমালোচনা এসেছে। এক্ষেত্রে আমাদের আলোচ্য এই ‘মুজাহিদ মুহাদ্দিস’ একজন বিরল ব্যতিক্রম। তিনিই ইতিহাসের একমাত্র মুহাদ্দিস, যাঁর ব্যাপারে কোন তানক্বীদ, সমালোচনা আসেনি। ইনাকেই আমরা চিনি আব্দুল্লাহ ইবনুল মুবারাক রাহ. নামে।
ইমাম আবু হানিফা রাহ. এর সমসাময়িক ও তাঁর অনুসারী ইমাম আব্দুল্লাহ ইবনুল মুবারাক রাহ. জন্ম গ্রহণ করেন ১১৮ হিজরীতে। রাফিকে আ’লার সান্নিধ্যে গমন করেন ১৮১ হিজরীতে।