শহরবাসীর কাছে সবচেয়ে বিরক্তিকর জায়গাগুলোর মধ্যে অবশ্যই বাসস্ট্যান্ড থাকবে। কখন বাস আসবে তার অপেক্ষা, বাস আসার পর কখন ছাড়বে তার অপেক্ষা, ছাড়ার পর জ্যাম পেরিয়ে বাসায় পৌঁছানোর অপেক্ষা। মানুষ অপেক্ষা ব্যাপারটাকে পছন্দ করে না। আমার কিন্তু একটুও খারাপ লাগে না এখানে থাকতে। আব্দুল্লাহপুর বাসস্ট্যান্ডে একটা লোকাল বাসের মধ্যে বসে আছি। আশেপাশে কতো বিচিত্র মানুষ। প্রতিটা মানুষ আলাদা। আলাদা তাদের জীবনের গল্পগুলো। এগুলো নিয়ে ভাবতে ভাবতেই সময় কেটে যায়। এই তো সামনেই তেল চপচপে চুলে সিঁথি করা এক ছেলে ব্যাগ হাতে দাঁড়িয়ে আছে। পড়াশুনা করতে দূরে কোথাও যাবে হয়তো। এক মহিলা একটু পরপরই ওকে জড়িয়ে ধরছেন। রাজ্যের উপদেশ দিচ্ছেন। বোঝাই যাচ্ছে ছেলেটার মা। লোকাল বাসস্ট্যান্ডে অস্থির মুখে এক যুবক দাঁড়িয়ে আছে। বাসায় যাবার তাড়া আছে হয়তো। বাসায় কী দেরিতে গেলে কেউ রাগ করে বসে থাকে? সামান্য দূরেই মধ্যবয়স্ক এক লোক একটু পরপর প্যান্টের পকেটে হাত দিচ্ছেন। বেতন পেয়েছেন হয়তো। বারবার পকেটে হাত দিয়ে দেখছেন টাকাগুলো পকেটে আছে কিনা! ছেলেমেয়েদের টিউশনের টাকা দিতে হবে। এতোগুলো টাকা হারালে বিপদ।
- “এতো মন খারাপ করে বসে আছো যে? বৌ মরে গেছে নাকি?”
মানুষের চিন্তা করতে করতে কোথায় হারিয়ে গিয়েছিলাম নিজেও জানি না। আমার বয়সী এক মেয়ে কণ্ঠের শব্দে সম্বিত ফিরে পেলাম। মেয়েমানুষ হয়ে আমার মতো হুজুরের পাশে বসেছে? তাও এমন ফ্রেণ্ডলি গলায় কথা বলছে!
পাশ ফিরে দেখি জয়া। আমার ছেলেবেলার ক্লাসমেট। ক্লাস ফাইভ থেকে একসাথে পড়েছি। খুব মেধাবী ছাত্রী ছিল। সবসময়ই ফার্স্ট-সেকেণ্ড হতো। ধবধবে সাদা শাড়ি পরেছে ও। কপালে লাল টিপ। ঠোঁটে কড়া করে লাল লিপিস্টিক। দাঁত বের করে এতো সুন্দর করে হাসছে! তাও চেহারার বেহাল দশা ঢাকতে পারছে না। ছোটবেলা থেকেই ওর স্বাস্থ্য ভালো ছিল বলে সবাই ওকে কতো খেপাতো। এখন অনেক শুকিয়ে গেছে। চোখে কালিও পরে গেছে। চোখ দেখেই বোঝা যায়, প্রচুর কান্নাকাটি করে ও। কতো রাত ঘুমায় না কে জানে!
আমি দ্রুত চোখ সরিয়ে নিলাম। ছিঃ! বেপর্দা একটা মেয়ের দিকে এতোক্ষণ তাকিয়ে ছিলাম!
- “কী জবাব দিলে না যে? ফেইসবুকে দেখি লেখালিখি করে ভাসায়া ফেলো। একবার মুমিন হলে জীবনে কোন দুঃখ-কষ্ট থাকবে না। আত্নসমর্পনেই নাকি শান্তি! তাহলে এখন মুখ কালো করে বসে আছো কেন?”
আমি বিব্রত হয়ে বাসের চারদিকে তাকালাম। বেশ ক’জন মানুষ আমার দিকে সন্দেহ নিয়ে তাকিয়ে আছে। পাঞ্জাবী পরা দাঁড়িওয়ালা ছেলের সাথে এমন মেয়ের বসে থাকাকে তারা মিলাতে পারছে না। বাস লোকে ভর্তি। উঠে যাব নাকি?
- “বুঝলাম তাকানো তোমার ইসলামে জায়েজ না। কথাও কি বলা যাবে না নাকি?”
আমি শান্ত গলায় থেমে থেমে বললাম,
- “আমি কোথাও লিখিনি মুমিন হলে জীবনে দুঃখ-কষ্ট থাকবে না। দুঃখ–কষ্ট তো আসবেই। আসবে কঠিন কিছু পরিক্ষা। কিন্তু আল্লাহর কাছে নিজেকে সঁপে দিলে কোথা থেকে যেন দানবীয় শক্তি আসবে সেই কষ্টগুলোর মুখোমুখি হবার। বিপদে ধৈর্য ধরার। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহিস সাল্লাম বলেছেন, “মুমিনের ব্যাপারটা খুবই আজব। যখন তার সাথে ভালো কিছু ঘটে, তখন সে কৃতজ্ঞ হয় আর এটাই তার জন্য উত্তম। আর যখন তার কোনো ক্ষতি হয়, তখন সে সবর করে আর এটাও তার জন্য উত্তম।”
- “হুম তোমাদের মুমিনদের এই একটা সুবিধা। ভালো কিছু হলে ‘আলহামদুলিল্লাহ’ বলো আর খারাপ কিছু হলে ‘এটা একটা পরীক্ষা’ বলে পার পেতে চাও।”
- “বরং আমাদের জীবন তোমাদের মতো প্যাথেটিক না যে জীবনে হতাশা আসলে নিরাশ হয়ে যাব। আমাদের মন খারাপের রাতে আমরা আল্লাহর সাথে কথা বলি। রবীন্দ্রনাথের কবিতার বই কিংবা একটার পর একটা গান শোনার চেয়ে এটা হাজার গুণে ভালো। এগুলো তো খালি হতাশাই বাড়ায় । দুই জগতের বাসিন্দা হিসেবে আমার এটা জানা আছে।”
আগের মতোই হাসি-খুশি গলায় জয়া বলল, “বাব্বা! হুজুর হয়েছো। কিন্তু পিন মেরে কথা বলার অভ্যাস দেখি এখনো ছাড়তে পারোনি। আমার অবশ্য হুজুর দেখলেই গা ঘিন ঘিন করে। তোমাকে অবশ্য খুব একটা খারাপ লাগছে না। দাঁড়িতে তোমাকে ভালোই মানিয়েছে। তোমার প্রতি ছোটকাল থেকে একটা ভালো লাগা ছিল বলেই হয়তো এমনটা মনে হচ্ছে। তোমার নাকে কী হয়েছে? চশমা পরতে পরতে কি দাগ বসিয়ে ফেলেছো?”
আমার ইচ্ছা হলো কড়া গলায় বলি, “দ্যাটস নান অফ ইউর বিজনেস! প্লীজ এক্সকিউজ মি।”
অনেক কষ্টে নিজেকে চেক দিলাম। ঝাঁঝালো গলায় বললাম, “তুমি কি একটু সরে বসবে? আমার অস্বস্তি লাগছে।”
অন্য যে কোন মেয়ে হলে অপমানে কালো হয়ে যেতো। কিন্তু ও একটুও ভ্রক্ষেপ না করে বলল, “তোমার এই স্পর্শ-জড়তা আমার কাছে নতুন কিছু না। মনে আছে, একবার চকলেট দেয়ার সময় যাতে আমার হাতে টাচ না লাগে এ জন্য তুমি এতো অদ্ভুতভাবে চকলেট দিচ্ছিলে যে চকলেট শেষমেশ তোমার হাত থেকেই পড়ে গেলো। প্রথমে ভাবলাম শুধু আমার সাথেই মনে হয় তুমি এমন করো। পরে দেখি, সব মেয়েকেই তুমি চর্মরোগী ভাব। মানুষজন মেয়ে লোকের স্পর্শ নেয়ার জন্য কী না করে! আর তুমি? জিজ্ঞেস করতে ভুলে গেছি, কেমন আছো?”
আমি ঠিক করলাম ওর কোন কথারই আর জবাব দেবো না। বলুক যা ইচ্ছা!
- "কি হলো আগের মতো এখনো এয়ারপ্লেন মোডে চলে গেছো নাকি? কথা বলো না কেন? বলো বলো বলো…………। তুমি কথা না বললে আমি আরো জোরে বলব। বলো বলো বলো…………।”
বাসের অধিকাংশ মানুষ তামাশা দেখছে। একজন বৃদ্ধ বিরক্ত হয়ে বারবার মাথা ঘুরিয়ে দেখছেন। কী মুশকিল!
আমি নীচু গলায় বললাম, “প্লীজ! আমাকে বিব্রত করো না। মানুষজন দেখছে। আমার প্রচণ্ড লজ্জা লাগছে।”
এবার ও প্রচণ্ড রেগে গেলো। রেগে গেলে ওর ঠোঁট ছোট হয়ে যায়। ঝাঁঝালো গলায় বলল,
- “হ্যাঁ! তোমার কাছে তো লোকে কী বলে ঐটাই ইম্পর্ট্যান্ট। একসময় ভাবতাম, মানুষের জন্যই হয়তো তুমি আমাকে রিজেক্ট করে দিয়েছো। আমি দেখতে সুন্দর না। তোমার সাথে যায় না। কতো চেষ্টা করলাম। কতো কিছু করলাম। তোমার মন পাওয়া গেলো না।”
- “জয়া! তোমাকে আগেও বলেছি চেহারা আমার কাছে ইম্পর্ট্যান্ট কিছু না। তোমার লিবারেল মেন্টালিটি আমার ভালো লাগে না। আমি ছেলেবেলা থেকেই ধার্মিক না হলেও যথেষ্ট কনজার্ভেটিভ। আর তোমাকে না করেছি কেন জিজ্ঞেস করলে? আজ তোমার জীবন আর আমার জীবনের দিকে তাকিয়ে দেখো না একবার। কতো আলাদা জীবন, কতো আলাদা পথ!”
জয়া সিরিয়াস গলায় বলল, “ধরো! আমি যদি এখন ধার্মিক হয়ে যাই, তাহলে কি তুমি আমায় বিয়ে করবে?”
আমি নির্লিপ্ত কণ্ঠে বললাম, “প্রশ্নই আসছে না। কারণ, তোমার ঐ ধার্মিকতা আল্লাহর জন্য হবে না। আমার জন্য হবে। আর মানুষের জন্য যা কিছু করা হয় তা তো একদিন ফিকে হয়ে যাবে।”
- “আচ্ছা মন থেকেই যদি ইসলাম কবুল করি?”
- “যেদিন সত্যিই মন থেকে ইসলাম কবুল করবে সেদিন নিজের অতীতের জন্য অনুতপ্ত হবে। এসব ফালতু প্রশ্ন মাথায় আসবে না। বাস চেরাগআলী এসে গেছে। তোমার নেমে যাওয়া উচিত।”
জয়া ধরা গলায় বলল, “আচ্ছা নেমে যাবো। আর কোনদিন তোমার সামনে এসে দাঁড়াব না। তোমায় বিরক্ত করব না। শুধু একবার বলো, তুমি কি আমায় ভালোবাসতে? প্লীজ একবার বলো। ভালোবাসতে? সত্যি বললে তো আর তোমার আল্লাহ রাগ করবেন না।”
আমি বিব্রত হয়ে ওর দিকে তাকালাম। চোখ ভাসিয়ে ও কাঁদছে। কাজলে দু চোখ লেপ্টে আছে।
- “আমার জানামতে তোমার একজন বয়ফ্রেণ্ড আছে। আমাকে এসব জিজ্ঞেস করার কি কোন অর্থ আছে?”
- “একবার না হয় নিরর্থক প্রশ্নেরই উত্তর দিলে। বলো না প্লীজ! শেষবার আমার অনুরোধটা রাখো। ভালোবাসতে?”
জয়া আমার হাত ধরতে চাইলো। আমি দ্রুত সিট থেকে উঠে সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকলাম। যথেষ্ট নাটক হয়েছে।
একটু পরেই একজন আমাকে ধাক্কা দিয়ে বাস থেকে নেমে গেলো। জয়া! দু হাত দিয়ে মুখ ঢেকে রাস্তা পার হচ্ছে। সবাই ওর দিকে তাকিয়ে আছে। মেয়েটা আরেকটু হলেই একটা বাসের নীচে পড়ে যেতো।
আমি ক্লান্ত হয়ে আবার সীটে বসে পড়লাম। বাস চৌরাস্তা পার হয়ে জয়দেবপুরের দিকে যাচ্ছে। আমার গন্তব্য বহু আগেই পার হয়ে গেছি। তবুও নামতে ইচ্ছা করছে না। অতীতের কথাগুলো অনেকদিন পর চোখে ভাসছে।
আমার জীবনে প্রথম লাভ-লেটার আমি ক্লাস এইটে পাই। আমার অপরিপক্কতার কারণেই অনেক ক্লাসমেট ব্যাপারটা জেনে গিয়েছিল। সবাই ব্যাপারটাতে খুব মজা পেতো। ভাবতো, আমি বুঝি ওকে পছন্দ করি। কাণ্ড দেখো! এই ছেলে কিনা এমন মেয়ের প্রেমে পড়েছে! অথচ কাহিনী ছিল একদম উল্টো। আমি ভদ্রভাবেই না করে দিলাম।
কলেজে আবার ও আমার সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করলো। এবার ফোনে। বলল, “পছন্দ করো না ঠিক আছে, বন্ধু হতে দোষ আছে?” ভাবলাম, তাই তো! বন্ধু তো হওয়াই যায়। সে বন্ধুত্ব যে কোথায় আমায় নিয়ে যাবে তা কে জানতো? ওকে ‘হ্যাঁ’ বলে দিবো, এমন সময় ওর সাথে আমার ক্লাসমেট মাহফুজের রিলেশন হয়ে গেলো। নিজেকে গুটিয়ে নিলাম। তবে ফোনে টুকটাক কথা ঠিকই চলতো।
কলেজ জীবনের শেষে আল্লাহ তা’য়ালা হেদায়েত দিলেন। হালাল-হারামের জ্ঞান দিলেন। জীবনের উদ্দেশ্যটা জানালেন। ওকে সরাসরি বললাম, “তোমার সাথে কথা বলা ঠিক হবে না আর। আমি স্রষ্টার কাছে নিজেকে সঁপে দিবো ইন শা আল্লাহ। তুমিও তাই করো।” ও উল্টো বুঝলো। ভাবলো আমি হয়তো আর যোগাযোগ রাখতে চাচ্ছি না। আমাকে বলল, “তোমার এই ধার্মিকতা বেশিদিন থাকবে না। নাকি অজুহাত দিচ্ছ? বললেই হয় আমার সাথে কথা বলবে না।”
কলেজ শেষ হলো। ভার্সিটিতে প্রবেশ করলাম। আমি আমার জীবনের সিদ্ধান্তগুলো নিলাম, ও ওর জীবনের। ডিসিশানগুলো ছোট ছোট। কিন্তু ছোট ছোট এই সিদ্ধান্তগুলোই অনেক বড় পরিবর্তনের সূচনা করে দিলো। ঠিক করে দিলো, জীবনের বাকীটা পথ আমরা কে কোন পথে হাঁটব! এরপরেও শয়তানের ওয়াসওয়াসাতে মাঝে মাঝে ওকে দাওয়াহ দেয়ার চেষ্টা করেছি। কিন্তু নিজেরই বিপথে যাওয়ার অবস্থা হয়েছে। তারপর অনেক দিন বিচ্ছিন্ন। দেখা নেই, কথা নেই। প্রায় ৩ বছর পর আজ দেখা হলো।
আমার হঠাৎ করেই ইচ্ছা করলো বাস থেকে নেমে ওর কাছে যাই। বলি, “এই মেয়ে অনেক জ্বালিয়েছো আমাকে। যাও আংকেল-আন্টিকে রাজী করাও। আজই বিয়ে করে ফেলবো তোমাকে। বিয়ের পর কিন্তু এমন উচ্ছৃঙ্খল হয়ে চলতে পারবে না। লক্ষ্মী মেয়ে হয়ে থাকবে, ঠিক আছে? আর হিন্দুদের মতো লাল টিপ পরে আছো কেন? জানো মিশরে কারা টিপ পরতো? ফাজিল মেয়ে!”
আল্লাহ তা'য়ালা আমাদের কল্পনাতে কোন বাঁধ দেননি। আমরা চাইলেই অনেক কিছু কল্পনা করতে পারি। সে কল্পনায় জয়ার সাথে আমার বিয়ে হয়ে যায়। কোন এক শীতের রাতে ও আমার জন্য চা বানিয়ে নিয়ে আসে।
- “এ কী দাঁত-মুখ কুঁচকে চা খাচ্ছ কেন? চায়ে চিনি হয়নি? ইয়া আল্লাহ! চিনি তো দেইইনি।”
- “চিনি দিতে হবে না। তুমি তোমার আঙ্গুলটা ভিজিয়ে দাও চায়ে। এমনি চা মিষ্টি হয়ে যাবে।”
ও লজ্জায় লাল হয়ে বলে, “যাও! তোমার যা ঢঙ!”
কল্পনায় লাগাম দিতে হলো। যে মেয়ে আমার জন্য বৈধ না, তাকে নিয়ে এতো চিন্তা কেন করছি! আউযুবিল্লাহ!
আল্লাহ তা'য়ালা তো সবই দেখছেন। কতোবার ওকে মেসেজ দিতে গিয়ে আমি নিজের হাত সরিয়ে নিয়েছি তা তিনি দেখেছেন। আজ যখন ওকে খুব বলতে ইচ্ছা হচ্ছিলো, “হ্যাঁ! সত্যিই তোমাকে অনেক ভালোবাসতাম।”
তখন নিজের আবেগকে লাগাম পরিয়েছি। সেটাও তিনি জানেন। আমার দু’চোখের অশ্রু, ফিরে আসার দু’আ—সবই তো তিনি শুনেছেন। দেখেছেন। প্রতিটা মুহূর্ত যেন নিজের সাথে যুদ্ধ করে বেঁচে আছি। সালাফরা বলতেন, ‘আমাদের মন কখনো অলস থাকে না। মন যখন আল্লাহর স্মরণ থেকে সরে আসে, তখন তা অন্য কারো স্মরণে নিয়োজিত হয়ে যায়। তখনই সে মন প্রেমে পড়ে।’ আমি তো চেষ্টা করি, তারপরেও ভুল হয়ে যায়। ‘নিশ্চয়ই মানুষের মন মন্দ কর্মপ্রবণ, তবে সে নয় যার প্রতি আমার রব অনুগ্রহ করেন। আমার রব বড়ই দয়ালু, বড়ই ক্ষমাশীল।’
বাস ছুটে যাচ্ছে। মন চাচ্ছে অনন্তকাল বাসে বসে থাকতে। না পাওয়া জীবনের হিসাব মিলাতে। প্রচণ্ড বিষন্ন লাগছে। একটা সময় ছিল যখন বিষন্ন লাগলে কবিতা আওড়াতাম—
"জানি আমার কঠিন হৃদয়
চরণ রাখার যোগ্য সে নয় -
সখা, তোমার হাওয়া লাগলে হিয়ায়
তবু কি প্রাণ গলবে না?
না হয় আমার নাই সাধনা,
ঝরলে তোমার কৃপার কণা
তখন নিমেষে কি ফুটবে না ফুল
চকিতে ফল ফলবে না।
আড়াল দিয়ে লুকিয়ে গেলে
চলবে না।"
এখন অবশ্য অন্যভাবে বিষন্নতা দূরা করার চেষ্টা করি। বিষন্নতা দূর করার দু'আটা মনে মনে আওড়ালাম—
"আল্লাহুম্মা ইন্নি আবদুক, ইবনু আবদিক, ইবনু আমাতিক, না সিয়াতী বিয়াদিক, মা-দ্বিন ফিয়্যা হুকমুক, 'আদালুন ফিয়্যা ক্বাদায়ুক……"
"আল্লাহ গো! আমি তো তোমার দাস। তোমারই দাসের পুত্র। তোমার দাসীর পুত্র। আমার কপাল তোমার হাতে। আমার উপর তোমার নির্দেশ অবশ্যই বাস্তবায়ন হবে। আর তুমি আমার ব্যাপারে যে ফয়সালাই দাও না কেন সেটাই সঠিক। আল্লাহ গো! তুমি কুর'আনকে বানিয়ে দাও আমার হৃদয়ের প্রশান্তি, বক্ষের জ্যোতি। আমার বিষন্নতার অপসারণকারী। আমার দুঃখ দূরকারী।"
শেষ বিকেলের সূর্য ডুবে গেছে। চারদিক থেকে ভেসে আসছে আজানের শব্দ। আমি বাস থেকে নেমে গেলাম। মন তো অনেক কিছুই চাইবে। নিজের ইচ্ছার গোলামী না করে আমার রবের গোলামী করি বলেই তো আমি মুসলিম।
জীবনটা তো আর জান্নাত না। সব ইচ্ছা পূরণ হতে হবে তাই বা কে বলেছে?