একটা বিন্দু থেকে ১ ডিগ্রি কোণে সমান দৈর্ঘ্যের দুটো রেখা টানুন। যখন রেখা দুটোর দৈর্ঘ্য ১ সেন্টিমিটার, তখন তাদের প্রান্তবিন্দুর মধ্যে দূরত্ব খুব কম। প্রায় নন-এক্সিস্টেন্ট। আপনি দৈর্ঘ্য যতই বাড়াতে থাকবেন, দূরত্ব ততোই বাড়তে থাকবে। যখন দৈর্ঘ্য হবে ১ কিলোমিটার তখন রেখাদুটোর প্রান্তবিন্দুদ্বয়ের মাঝে দূরত্ব হবে প্রায় ১৭ মিটার। ১০ কিলোমিটার পর দূরত্ব হবে প্রায় ১৭০ মিটার। ১০০ কিলোমিটার পর দূরত্ব হবে এক মাইলের কাছাকাছি। আপনি রেখাগুলোকে যতোই লম্বা করবেন, দূরত্ব ততোই বাড়তে থাকবে।
অর্থাৎ পর্যাপ্ত সময় দিলে কেন্দ্র থেকে এক ডিগ্রি বিচ্যুতিও গন্তব্য থেকে যোজন যোজন দূরত্বে নিয়ে যাবার জন্য যথেষ্ট। এক সময় দেখবেন শুরুতে যেটা গোণায় ধরার মতো কিছু ছিল না, এক সময় সেটাই বিশাল একটা ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে।
এই নিরস, ড্রামাবিহীন, আনএক্সাইটিং উদাহরণটা দেয়ার কারণ কী? কারণ হল ইসলামের অপরিবর্তনীয় ও বুনিয়াদি বিষয়গুলোর ব্যাপারে চিন্তা করার সময় যদি আমরা এ উদাহরণটা মাথায় রাখি তাহলে কিছু বিষয় বোঝা ইন শা আল্লাহ অনুধাবন করা সহজ হবে।
আমরা যদি মুসলিম উম্মাহর ইতিহাসের দিকে, বিশেষ করে ডিভিয়েন্ট সেক্টস বা বাতিল ফিরকাগুলোর দিকে তাকাই তাহলে তাদের সকলের মধ্যে দুটো বৈশিষ্ট্য আমরা দেখতে পাবো।
১) বিভিন্ন আঙ্গিকে, বিভিন্ন অজুহাতে আল্লাহর রাসূলের (সাঃ) সুন্নাহকে আংশিক বা সম্পূর্ণভাবে অস্বীকার করা বা তার ভুল ব্যাখ্যা করা।
২) আস সালাফ আস-সালেহিন, বিশেষ করে সাহাবায়ে কেরামের রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুম ওয়া আজমাইন দৃষ্টিভঙ্গি বা অবস্থান প্রত্যাখ্যান করা।
খাওয়ারিজ থেকে শুরু করে শি’আ, আল-ফালাসফা, কারামাতিয়্যাহ, ক্বাদারিয়্যাহ, জাবিরিয়্যাহ, জাহমিয়্যাহ, মু’তাযিলা, মুরজি’আ, ক্বাদিয়ানি, বাহাইসহ যতোগুলো বাতিল ফিরকা আছে এদের সবার মধ্যে এ দুটো বৈশিষ্ট্য আপনি পাবেন। মজার ব্যাপারটা হল ক্বুর’আন বিশ্বজগতের অধিপতির পক্ষ থেকে নাযিল হওয়া ওয়াহী—এই কথা এরা সবাই মোটা দাগে স্বীকার করে। অর্থাৎ ক্বুর’আনের ব্যাপারে এদের আপত্তি নেই। বরং আপনি দেখবেন, শি’আ হোক, ক্বাদিয়ানী হোক, এরা সবাই ক্বুর’আনের আয়াত ব্যবহার করেই দলিল দিচ্ছে। এমনকি বাংলাদেশে যেসব ক্রিশ্চিয়ান মিশনারীরা কাজ করে, এরাও ক্বুর’আন থেকেই নিজেদের পক্ষে “দালিল” দেয়। সাধারণ মুসলিমদের অজ্ঞতার সুযোগ নিয়ে তাদের বিভ্রান্ত করে।
কিন্তু এদের সমস্যাটা হল রাসূলুল্লাহর (সাঃ) সুন্নাহ নিয়ে, তাঁর (সাঃ) হাদিস নিয়ে, সাহাবায়ে কেরামের রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুম ওয়া আজমাইন দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করা নিয়ে। উপরে যে ফিরকাগুলোর নাম বললাম এদের মধ্যে কেউ সরাসরি সাহাবীদের সাথে যুদ্ধ করেছে, কেউ সাহাবীদের দু-একজন বাদে বাকিদের কাফির ঘোষণা করেছে, কেউ তাদের দ্বীনের বুঝকে ভুল, অগভীর কিংবা অনুন্নত বলেছে, কেউ দ্বীনের বিভিন্ন বিষয়ে তাদের ব্যাখ্যাকে বাতিল ও ভুল ঘোষণা করেছে—রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুম ওয়া আজমাইন।
অন্যদিকে রাসূলুল্লাহর (সাঃ) সুন্নাহর ক্ষেত্রে, এদের কেউ সরাসরি অস্বীকার করেছে আংশিক কিংবা সম্পূর্ণভাবে। কেউ নিজেরা মনগড়া হাদিস বানিয়ে সেগুলোর অনুসরণ করা নিজেদের উপর ফরয করে নিয়েছে, কেউ হাদিসকে অনির্ভরযোগ্য বলেছে। কেউ হাদিসের বক্তব্য ও সুন্নাহকে একটা নির্দিষ্ট সময়ের ফ্রেমে আবদ্ধ করতে চেয়েছে, অর্থাৎ এগুলো শুধু একটি নির্দিষ্ট সময়ের প্রযোজ্য ছিল—এমন অবস্থান গ্রহণ করেছে। কেউ কিছু হাদিস গ্রহণ করেছে বাকিগুলো বেমালুম ভুলে গেছে। ঐ যে, “আমরা সুন্নাহ পালন করি তবে খালি মিষ্টি খাওয়ার সুন্নাহ”—অনেকটা এরকম।
সব বিভ্রান্ত ফিরকার মধ্যে এ দুটো বৈশিষ্ট্য থাকা কোন কাকতাল না। বরং তাদের বিচ্যুতির সাথে এ বিষয়গুলো মৌলিকভাবে জড়িত। কারণ হাদিস ও সালাফ আস সালেহীনের দৃষ্টিভঙ্গি হল উম্মাহর জন্য শেকড়ের মতো। হাদিস ও দ্বীনের বুনিয়াদি বিষয়গুলোর ক্ষেত্রে সালাফ আস সালেহিনের অবস্থান থেকে বিচ্যুতি হলে কেন্দ্র থেকে বিচ্যুতি। শুরুতে যতো তুচ্ছভাবেই এটা শুরু হোক না কেন, এক সময় এটা মিল্লাতু ইব্রাহিম থেকে সম্পূর্ণভাবে আপনাকে গোমরাহ করে দেবে। আর আমি এখানে কোন মাসায়েল বা ফিক্বহি মতকে বোঝাচ্ছি না, দ্বীনের মৌলিক, অপরিবর্তনীয় বিষয়গুলোকে নিয়ে দৃষ্টিভঙ্গি ও অবস্থানের কথা বলছি।
যখনই কেউ দ্বীনের মধ্যে নতুন কিছু উদ্ভাবন করতে চায়, দ্বীনকে বিকৃত করতে চায়, কিংবা দ্বীন থেকে নিজের খেয়ালখুশির জাস্টিফিকেশান তৈরি করতে চায় তখন তার সামনে মূল বাঁধা হয়ে দাঁড়ায় হাদিস ও সালাফ আস সালেহিনের অবস্থান। দ্বীনের মধ্যে নতুন কোন বিষয় উদ্ভাবনের বিরুদ্ধে, দ্বীনকে বিকৃত করার বিরুদ্ধে, কেন্দ্র থেকে বিচ্যুতির বিরুদ্ধে এ দুটো বিষয় হল উম্মাহর জন্য সেইফটি লকের মতো। দ্বীনকে খেয়ালখুশি মতো বদলাতে চাওয়া প্রত্যেক ব্যক্তি ও দলের জন্য এ দুটি হল এমন দুটি পাহাড় যেগুলো না পার হওয়া সম্ভব, না ভেদ করা।
একজন শি’আ, একজন ক্বাদিয়ানি, একজন জাহমি ক্বুর’আনের আয়াতের ভুল ব্যাখ্যা করে পার পেয়ে যেতে পারে। কিন্তু যখনই হাদিসের মাপকাঠিতে, খাইরুল ক্বুরুনের অবস্থানের আলোকে তাদের বক্তব্যকে বিশ্লেষণ করা হবে তখন জারিজুরি শেষ। তখন তাকে হয় হাদিসকে অস্বীকার করতে হবে, সালাফ আস সালেহীনের অবস্থানকে ভুল বলতে হবে অথবা তর্ক ছেড়ে পালাতে হবে।
আধুনিক সময়ে জন্ম নেওয়া মর্ডানিস্ট, রিফরমিস্ট, রিভিশনিস্ট, “ইসলামিক” ফেমিনিস্টসহ (ইসলামিক ফেমিনিস্ট—কথাটা আসলে একটা অক্সিমোরন। অনেকটা ইসলামিক হেইডোনিস্ট বা ইসলামিক ম্যাটেরিয়ালিস্টের মতো। স্কার্ফি ফেমিনিস্ট বা ত্যানা প্যাচানো ফেমিনিস্ট নাম হিসেবে আরো অ্যাপ্রোপ্রিয়েট) অন্যান্য নানা মুভমেন্টের মধ্যেও আপনি এই দুটো বৈশিষ্ট্য দেখতে পাবেন। উইতআউট এনি এক্সসেপশান; এদের সকলের মধ্যেই আপনি এ দুটো বৈশিষ্ট্য পাবেন।
কারণটা বোধগম্য। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এ ধরনের মুভমেন্টগুলোর ভরসা করতে হয় দ্বীনের মধ্যে নতুন ব্যাখ্যা তৈরির উপর। আর যদি কখনো এরা দলিল আনে তখন এরা এক্সসেপশানকে জেনারেল রুল হিসেবে চালিয়ে দিতে চায়। ব্যতিক্রমকে উদাহরন ধরে তা থেকে ‘আম হুকুম বের করে। আর যদি তারা হাদিস ও বুনিয়াদি বিষয়গুলো নিয়ে সালাফ আস সালেহিনের অবস্থানকে মেনে নেয় তাহলে নিজেদের অবস্থানকে ইসলামের দৃষ্টিকোণ থেকে সমর্থনের বা জাস্টিফাই করার কোন পথ তাদের থাকে না। তাই মৌলিক ভাবে, এক্সিসটেনশিয়ালি এধরনের দর্শন ও মুভমেন্টগুলো হাদিস (আংশিক বা সম্পূর্ণভাবে) ও সালাফ আস সালেহিনের দৃষ্টিভঙ্গি ও অবস্থানের বিরোধিতা অথবা নব-উদ্ভাবিত ব্যাখ্যা করতে বাধ্য। যদি আজ তারা এই বিরোধিতা (বা বিকৃত ব্যাখ্যা) বন্ধ করে তাহলে কাল থেকে কার্যত তাদের অস্তিত্বই থাকবে না।
তাই হাদিসকে অনির্ভরযোগ্য বলা (কিংবা “messed up” বলা), সাহাবায়ে কেরামের ইজমাকে ভুল বলা, রাদ্বিয়াল্লহু আনহুম ওয়া আজমাইন, সালাফদের বুঝ সম্পূর্ণ না—এধরণের চিন্তা অত্যন্ত বিপদজনক। অত্যন্ত গুরুতর বিষয়। এটি কোন মাস’আলা-মাসায়েলের বিষয় না, কোন মাযহাবগত বা ফিক্বহি পার্থক্যের মতো বিষয় না। এ বিষয়গুলোকে নিয়ে প্রশ্ন তোলা দ্বীনের ভিত্তি নিয়ে প্রশ্ন তোলা। আপনি একটু চিন্তা করলেই দেখবেন হাদিস নিয়ে, হাদিসের বক্তব্য নিয়ে, হাদিসের বর্ননাকারীদের নিয়ে, অথবা কুরআনের আয়াত ও হাদিস নিয়ে সালাফদের বুঝ নিয়ে যদি আপনি প্রশ্ন তোলেন তাহলে ক্বুর’আনকে নিয়েও লজিকালি প্রশ্ন তোলা উচিত। সমস্ত দ্বীন নিয়েই আসলে প্রশ্ন করা উচিত।
যে মানুষগুলো হাদিস বর্ণনা করেছেন তারাই ক্বুর’আন সংকলন করেছেন। একই প্রজন্ম—রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুম ওয়া আজমাইন। যদি আপনি বলেন তাদের বর্ণিত হাদিস নির্ভরযোগ্য না, তাহলে এই একই মানুষগুলো নির্ভরযোগ্যভাবে আল্লাহর আয়াত সংরক্ষণ করেছেন এটা কিভাবে আমরা ধরে নিতে পারি? যদি কেউ বলেন সাহাবিরা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুম ওয়া আজমাইন যা বলেছেন তা পরবর্তী বর্ণনাকারীরা বদলে ফেলেছেন তাহলে প্রশ্ন হবে এই একই কাজ যে ক্বুর’আনের ক্ষেত্রে হয়নি সেটা কিভাবে নিশ্চিত হচ্ছেন?
যদি মুফাসসিরগণকে নিয়ে প্রশ্ন তোলেন তাহলে আসলে আপনার উচিত সালাফ আস সালেহিনকে নিয়ে প্রশ্ন তোলা, কারণ ক্লাসিকাল কোন তাফসিরের কিতাবে আপনি দেখবেন না “আমার মতে” দিয়ে কোন আয়াতের আলোচনা শুরু হয়েছে। বরং কোন আয়াতের ব্যাপারে কোন সালাফদের মধ্যে কে কী বলেছেন তার উপর ভিত্তি করেই মুফাসসিরগণ আলোচনা করেন।
যদি আপনি বলেন হাদিস নির্ভরযোগ্য না, তাহলে রাসূলুল্লাহর (সাঃ) জীবন সম্পর্কে আপনি যা যা জানেন, সেটা কিভাবে নির্ভরযোগ্য বলে ধরে নিচ্ছেন? যে উৎস থেকে আপনি হাদিস পাচ্ছেন সেই একই উৎস থেকেই আপনি রাসূলুল্লাহর (সাঃ) সম্পর্কে জানতে পারছেন। যদি আপনি ইবাদাতের দিকে তাকান, তাহলে একবার চিন্তা করে দেখুন সালাত আদায়ের নিয়ম, হজ্জ করার নিয়ম, ক্বুরবানির মাসায়েল, শারীয়াহসম্মত বিয়ের নিয়ম—এসব কিছু কোথা থেকে আমরা পাচ্ছি? ক্বুর’আনে তো এই ডিটেইলস গুলো নেই। প্রতি ওয়াক্তে সালাত কয় রাকাত, সুন্নাহ কয় রাকাত, ফরয কয় রাকাত—এটা ক্বুর’আনে কোথায় আমরা পাচ্ছি?
প্রকৃতপক্ষে সম্পূর্ণ দ্বীন নিয়ে প্রশ্ন তোলা ছাড়া হাদিসশাস্ত্র নিয়ে প্রশ্ন তোলার সুযোগ নেই। যদি আসলেই আপনি লজিকালি জিনিসটা অ্যাপ্রোচ করেন। এখন কেউ কেউ বলতে পারেন—যে মুভমেন্টগুলোর কথা বলা হয়েছে তাদের অনেকেই সম্পূর্ণভাবে হাদিস অস্বীকার করে না। কিছু কিছু হাদিস অস্বীকার করে। কিছু নির্দিষ্ট বিষয়ের হাদিস তারা অনির্ভরযোগ্য বলেন। একারণে ঢালাও ভাবে তাদেরকে বাতিল ফিরকাগুলোর সাথে গুলিয়ে ফেলা কিভাবে যৌক্তিক হয়?
সেক্ষেত্রে উত্তর হবে—হ্যাঁ, এরকম অনেক উদাহরণ আছে যে বিভিন্ন হাদীসের ব্যাপারে বিভিন্ন মুহাদ্দিসিন বিভিন্ন মত প্রকাশ করেছেন। আমাদের সময়ে এর সবচেয়ে ভালো উদাহরণ শায়খ আলবানী রাহিমাহুল্লাহ। তিনি অনেক হাদিসের সনদের ব্যাপারে পূর্ববর্তীদের থেকে ভিন্নমত পোষণ করেছেন। এরকম অনেক উদাহরণই উম্মাহর ইতিহাসে আছে। যেমন বর্তমানেও শায়খ সুলাইমান আল-‘উলওয়ান (ফাকাল্লাহু আসরাহ) এবং শাইখ আব্দুল ‘আযিয আত-তারিফি (হাফিযাহুল্লাহ) কুফর দুনা কুফর সংক্রান্ত ইবন আব্বাস রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুর ক্বওল ও শাসকের আনুগত্য সংক্রান্ত একটি বর্ণনার একটি লাইনের সনদ সম্পর্কে আহলুস সুন্নাহর অনেক আলিমদের থেকে ভিন্নমত পোষণ করেছেন। তাই কোন একটি হাদিস বা একাধিক হাদিসের সনদ নিয়ে, বা সেগুলোর সাহিহ বা যইফ হওয়া নিয়ে ভিন্নমত পোষণ অবশ্যই অপরাধ না।
তবে কোন নির্দিষ্ট হাদিসের ব্যাপারে প্রশ্ন তোলার নির্দিষ্ট নিয়ম আছে। আহলুস সুন্নাহ হাদিস সংরক্ষণের ক্ষেত্রে শুধু হাদিসের বক্তব্যকে হুবহু সংরক্ষণের দিকেই জোর দেয় নি, বরং হাদিসের বর্ণনাকারীদের ব্যাপারেও গুরুত্ব দিয়েছে। শুধুমাত্র হাদিসের বর্ণনাকারীদের নিয়েই একাধিক শাস্ত্র আছে। বিষয়টা এমন না যে আমার হঠাৎ করে মনে হলে, এই হাদিসটা আমার কেমন কেমন লাগছে তাই এটা অনির্ভরযোগ্য। তাই যদি কেউ হাদিসের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন করতে চায় তাহলে তাকে অবশ্যই সে নির্দিষ্ট নিয়মে প্রশ্ন করতে হবে।
একইসাথে এই ধরনের আলোচনা শুধুমাত্র একজন উচ্চ পর্যায়ের মুহাদ্দিস করতে পারেন। কারণ এধরনের একটা গবেষণা ও ভেরিফিকেশানের জন্য যে পর্যায়ের পড়াশোনা করা দরকার সেটা সাধারণ মাদ্রাসা স্টুডেন্টেরও আয়ত্তের মধ্যে পড়ে না। ঠিক কোন পর্যায়ের যোগ্যতা প্রয়োজন হতে পারে তার একটা উদাহরণ দেই। শায়খ সুলাইমান আল ‘উলওয়ান সিহাহ সিত্তাহর ছয়টি কিতাব মুখস্থ করেছেন। ছয়টি খন্ড না। বুখারি শরিফের সকল খন্ড, মুসলিম শরীফের সকল খন্ড—এভাবে সমগ্র সিহাহ সিত্তাহ। তিনি এই সকল হাদিসের সনদ মুখস্থ করেছেন, এবং হাদিসের সনদের থাকা বর্ণনাকারীদের ব্যাপারে তথ্য মুখস্থ করেছেন। এবং তিনি নবী (সাঃ) থেকে অবিচ্ছিন্ন সূত্রে একাধিক হাদিস বর্ণনা করেন।
লক্ষণীয় বিষয় হল এতো যোগ্যতা—সত্যিকারের ‘ইলমি যোগ্যতা, সেক্যুলার ডিগ্রির যোগ্যতা না—থাকার পরও শায়খের কথা ফেইস ভ্যালুতে তো গ্রহণ করা হয়ই না, দলিল উপস্থাপনের পরও গভীর বিশ্লেষণ ছাড়া সেই বিষয়ে অন্যান্য মুহাদ্দিসিনগণ মত প্রকাশ করেন না। অন্যদিকে শায়খও তার যোগ্যতার, কিংবা ইজাযাহর কিংবা এনসাইক্লোপেডিক মেমরির দোহাই দিয়ে, অনুনয় বিনয়, কিংবা ধমক দিয়ে, আবেগ ব্যবহার করে, নানা নকশা করে নিছক তার মুখের কথার উপর তাকে বিশ্বাস করতে বলেন না।
প্রশ্ন হল মর্ডানিস্ট, রিফর্মিস্ট, রিভিশনিস্ট, স্কার্ফি ফেমিনিস্টসহ অন্যান্য যারা ক্যাযুয়ালি কোন একটি হাদিসের ব্যাপারে নির্ভরযোগ্যতা বা অনির্ভরযোগ্যতার সার্টিফিকেট দিয়ে দিচ্ছেন, তারা কি এই পর্যায়ের যোগ্যতা রাখেন? যেভাবে সালাফদের বুঝের বাইরে গিয়ে তারা কুরআন-হাদিস-সীরাত ব্যাখ্যা করা শুরু করেছেন সেটার যোগ্যতা কি তাদের আছে? নাকি বর্তমানে যেরকম দেশেবিদেশে ডু-ইট-ইউরসেলফ সেলিব্রিটি মুফাসসিরিন তৈরি হচ্ছে, সেইভাবে মুহাদ্দিসিনও তৈরি হচ্ছে?
দ্বিতীয় প্রশ্ন হল, তারা যদি হাদিসের সনদ বা মতন নিয়ে আপত্তি তোলেন তবে সেই দালিলিক আলোচনাটা কি তারা উপস্থাপন করেন বা আদৌ কখনো করবেন যার ভিত্তিতে তারা আপত্তি করছেন?
তৃতীয়ত, যদি কোন নির্দিষ্ট হাদিসকে তারা অগ্রহণযোগ্য বলে থাকেন তবে কি ঐ একই বর্ণনাসূত্রে পাওয়া অন্য যত হাদিস আছে তার সবই তারা অস্বীকার করেন বা অনির্ভরযোগ্য বলেন? না বললে কেন বলেন না?
চতুর্থত, যদি তাদের প্রশ্ন সনদ নিয়ে না হয় তবে কি মতন অর্থাৎ রাসূলুল্লাহ (সাঃ) যা বলেছেন সেটা নিয়ে কি তাদের আপত্তি?
এ প্রশ্নগুলো নতুন প্রশ্ন না। কয়েক দশক ধরেই এ প্রশ্নগুলো করা হচ্ছে, এবং নব উদ্ভাবিত এসব “মুভমেন্ট”-গুলোর নেতা-নেত্রীরা উত্তর দিচ্ছেন না বা দিতে পারছেন না। এ প্রশ্নগুলোর উত্তর এখন দেওয়া হবে এটা আশা করাটাও বোকামি। কারণ সত্য হল, কাফিরদের দেশে স্বেচ্ছায় বসবাস করা হোক, কিংবা ফ্রি-মিক্সিং বা নারীদের ঘরে অবস্থানের ব্যাপারে হোক—এধরনের “মুভমেন্ট”গুলো এসব বিষয়ে দালিলিক ভাবে তাদের উপসংহারে বা অবস্থানে পৌছায় না। বরং তারা প্রথমে একটি অবস্থান গ্রহণ করে এবং তারপর চেষ্টা করে দালিলের বিকৃত ব্যাখ্যার মাধ্যমে নিজেদের অবস্থানকে শার’য়ী বৈধতা দেয়ার।
কিছু সময়ের জন্য তারা এতে সফল হয় সাধারণ মুসলিমদের অজ্ঞতা, উদাসীনতা আর আবেগের ব্যবহারের কারণে, কিংবা শুরুতে নিজের প্রকৃত বিশ্বাস গোপন করার মাধ্যমে। আর তারপর অবধারিত ও শোচনীয়ভাবে তারা তাদের এই প্রচেষ্টায় ব্যর্থ হয় এবং জোড়াতালি দিয়ে শার’য়ী জাস্টিফিকেশান দেওয়ার চেষ্টা বাদ দিয়ে খোলাখুলিভাবে নিজেদের অবস্থান প্রকাশ করে। অবধারিতভাবেই এটা ঘটে। হয় তারা পূর্বের অবস্থান থেকে ফিরে আসে অথবা রেখার দৈর্ঘ্য বাড়ার সাথে সাথে কেন্দ্র থেকে বিচ্যুতি ক্রমান্বয়ে বাড়তে থাকে।
শেষ করছি এমন একজন মানুষের উক্তি দিয়ে যিনি একই সাথে শি’আ, মু’তাযিলা, জাহমি ও ক্বাদিরিয়্যাহদের বিরুদ্ধে লড়েছিলেন। আর যিনি মৃত্যুর প্রায় এক হাজার বছর পরও ওরিয়েন্টালিস্টদের মাথাব্যাথার কারণ হয়ে আছেন—ইমাম আবু মুহাম্মাদ আল হাসান আল বারবাহারি আল-হাম্বলি রাহিমাহুল্লাহ। যারা অত্যাধিক কঠোরতার দোষে দুষবেন, কিংবা ঐক্যের খাতিরে ঐক্যের কথা বলবেন, কিংবা “ভালোটা গ্রহণ আর খারাপটা বর্জন”—এর নীতি অনুসরণের কথা বলবেন আশা করি এই উক্তিটি তাদের জন্য জবাব হিসেবে এ মুহূর্তে যথেষ্ট হবে। ইমাম আল-বারবাহারি বলেন
শেষ করছি এমন একজন মানুষের উক্তি দিয়ে যিনি একই সাথে শি’আ, মু’তাযিলা, জাহমি ও ক্বাদিরিয়্যাহদের বিরুদ্ধে লড়েছিলেন। আর যিনি মৃত্যুর প্রায় এক হাজার বছর পরও ওরিয়েন্টালিস্টদের মাথাব্যাথার কারণ হয়ে আছেন—ইমাম আবু মুহাম্মাদ আল হাসান আল বারবাহারি আল-হাম্বলি রাহিমাহুল্লাহ। যারা অত্যাধিক কঠোরতার দোষে দুষবেন, কিংবা ঐক্যের খাতিরে ঐক্যের কথা বলবেন, কিংবা “ভালোটা গ্রহণ আর খারাপটা বর্জন”—এর নীতি অনুসরণের কথা বলবেন আশা করি এই উক্তিটি তাদের জন্য জবাব হিসেবে এ মুহুর্তে যথেষ্ট হবে। ইমাম আল-বারবাহারি বলেন—
“যদি তুমি দেখো কোন ব্যক্তি বর্ণনাগুলোর সমালোচনা করছে, আল্লাহর রাসূলের (সাঃ) কাছ থেকে আসা কোন একটি বর্ণনা অস্বীকার করছে, তবে তার ঈমান নিয়ে সন্দেহ কর। কারণ সে হল জঘন্য বক্তব্য ও ঘৃণ্য মতবাদের একজন ব্যক্তি। প্রকৃতপক্ষে সে আল্লাহর রাসূল (সাঃ) ও তাঁর (সাঃ) সাহাবীদের আক্রমন করছে। কারণ আমরা (মুসলিম উম্মাহ) তো এ বর্ণনাসমূহের মাধ্যমেই আল্লাহ, তাঁর রাসূল (সাঃ), ক্বুর’আন, ভালোমন্দ ও আখিরাত সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করেছি।” [শারহ আস-সুন্নাহ]