আমরা যে বাসায় থাকি তার পাশের বিল্ডিং এর মালিক, তাদের দুই সন্তান, একটি ছেলে একটি মেয়ে। দুইটাই প্রতিবন্ধী। ছেলেটা প্রায় সারাদিন অস্পষ্ট ভাষায় চিৎকার চেঁচামেচি করে। পরপর দুইটি সন্তান প্রতিবন্ধী হওয়ার পর ভয়েই হয়তো তারা আর সন্তান নেননি। তাদের সব আছে, কিন্তু শান্তি কি আছে? দুইটি প্রতিবন্ধী সন্তান নিয়ে তাদের ভবিষ্যৎ চিন্তা কি, বাবা-মা মারা গেলে এই দুই সন্তানকে কে দেখবে?
আমার বোনের শ্বশুরবাড়িতে আমার বোন, বোনের দুই ননদ-জা সবার সন্তান ছেলে, কারো মেয়ে নেই। সম্প্রতি বোনের ননদের দ্বিতীয় বাচ্চা হয়েছে, বাড়ির সবাই কত করে চাচ্ছিল এটা যেন মেয়ে হয়। আমার এক কাজিনের পাঁচটা সন্তান, সব ছেলে, একটা মেয়ে তারা কত করে চেয়েছেন! আবার আমার আরেক কাজিন, বিয়ের কয়েক বছর হয়ে গেছে, আল্লাহ তাদের কোনো বাচ্চা দেননি। আমার গ্রামের বাড়ির এক গরীব রিকশাচালক, তার চার পাঁচটা সন্তান, সব মেয়ে, একটা ছেলের জন্য তাদের কত আকুতি।
আল্লাহ তাআলার নিয়ামতে বরকত প্রাপ্তির প্রথম ধাপ হলো সেই নিয়ামতের শুকরিয়া আদায় করা। আর এই শুকরিয়া আদায় করার সহজ উপায় হলো যে নিয়ামত আপনার আছে, সেই নিয়ামত যাদের নেই তাদের সাথে নিজেকে তুলনা করে দেখা। আপনার সন্তান মেয়ে বলে অসন্তুষ্ট, অথচ দেখুন কত নিঃসন্তান দম্পতি শুধু একটি সন্তানের জন্য কেঁদে মরছে। কত দম্পতি আফসোস করে মরছে তাঁদের কোনো মেয়ে নেই বলে। কতো দম্পতি কষ্টে মরছে, কারণ তাঁদের সন্তান প্রতিবন্ধী।
প্রিয় শাইখ আব্দুল আযীয আত তারিফী বলেন, "আল্লাহর দেওয়া নিআমতের শোকর আদায় করলে দুটি নি’আমত পাওয়া যায়। একটি হলো সেই নিআমতটি স্থায়ী হওয়া, আরেকটি হলো সেটিতে বরকত লাভ করা (কল্যাণজনকভাবে বৃদ্ধি পাওয়া)। নিআমতের না-শোকরি করলে আল্লাহ সেই নি’আমত ছিনিয়ে নেন। আর যদি ছিনিয়ে না-ও নেন, তাহলে তার মধ্য থেকে বরকত উঠিয়ে নেন।" (সবুজ পাতার বন, ১৩৯ পৃষ্ঠা)
বর্তমান শিক্ষিত শ্রেণির মানুষের মধ্যে মেয়ে সন্তান নিয়ে নাক সিটকানি, অসন্তোষ তেমন একটা দেখা না গেলেও, গ্রামের দিকে দুঃখজনকভাবে মেয়ে সন্তান নিয়ে অসন্তুষ্টি আছে। এটা খুব ভয়াবহ। মেয়ে সন্তান হলে অনেকে এভাবে রিএকশান দেখায় যা কুফরির পর্যায়েও পড়ে। আমার ভাইয়ের বাচ্চা হওয়ার সময় হাসপাতালে ছিলাম। এক মহিলার সন্তান হয়েছে, মহিলা, মহিলার মা সবাই কাঁদছে। একজন জিজ্ঞেস করল কি হয়েছে, বাচ্চার কোনো সমস্যা হয়েছে কিনা, তারা বলল, মহিলার এর আগের সব সন্তান মেয়ে, এবারও মেয়ে হয়েছে, মহিলার স্বামী বা শ্বশুরবাড়ির কেউ আসেনি। সন্তান হওয়ার পর ঐ হাসপাতালে তিন দিন থাকার নিয়ম, তারা কাঁদতে কাঁদতে ঐদিনই চলে গেছে।
অথচ আমাদের প্রিয় নবীজি (সাঃ) যে সন্তানেরা জীবিত ছিলেন তারা সবাই ছিলেন মেয়ে। সহিহ মুসলিমে এসেছে নবীজি (সাঃ) বলেছেন, যার দুটি মেয়ে সন্তান আছে, সাবালক হওয়া পর্যন্ত তাদের ভরণপোষণ করবে—কেয়ামতের দিন সে আর আমি (পাশাপাশি থাকব) এবং (এ কথা বলে) তিনি তার আঙুলগুলো মেলালেন। অর্থাৎ, আঙুলের মত পাশাপশি থাকব।
আরেকটি হাদিসে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেন, কোনো ব্যক্তির যদি একজন কন্যা সন্তান থাকে এবং সে তাকে হত্যা করেনি, কোন প্রকার অবহেলা করেনি এবং পুত্র সন্তানকে কন্যা সন্তানের উপর কোন প্রকার প্রাধান্য দেয়নি। আল্লাহ তাকে অবশ্যই জান্নাতে প্রবেশ করাবেন। (মুসনাদে আহমদ: ২২৩/১)
আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার। অজ্ঞতার কারণে অনেক পরিবারে মেয়ে সন্তান হওয়ার জন্য মা'কে দায়ী করা হয়, তাকে অপয়া উপাধি দেওয়া হয়। কোনো দম্পতির যদি ছেলে সন্তান না হয়, সেজন্য মেডিক্যালি দায়ী মূলত বাবা। কারণ ছেলে সন্তান হওয়ার জন্য যে Y ক্রোমোজোম দরকার সেটা থাকে পুরুষের কাছে। ছেলে-মেয়ে যাই হোক সেটা আল্লাহর নিয়ামত, দ্বীনের এই শিক্ষার পাশাপাশি আমাদের আত্মীয়স্বজন, পাড়া প্রতিবেশীদের মাঝে ছেলে সন্তান না হলে মেডিক্যালি এর দায় যে বাবার—এই ব্যাপারেও সচেতনতা তৈরি করা উচিত। যারা এসব জানেন তারা পরিচিত কোনো পরিবারে এরকম হচ্ছে জানতে পারলে তাদেরকে বুঝিয়ে বলবেন, বিশেষ করে শাশুড়িকে।