আমার আরবি শেখার প্রচেষ্টার শুরু ২০০৩ সালে। ঢাবিতে ভর্তির পরেই আধুনিক ভাষা ইনসটিটিউটে বন্ধুরা গিয়ে ঢুকলাম। কেউ ভর্তি হলো ফ্রেঞ্চে, কেউ জর্মন, কেউ স্প্যানিশ। আমি একাই ভর্তি হলাম আরবিতে।
একদিন ক্লাস করার পরে বুঝে গেলাম - এখানে আরবি শেখা যাবে না।
তারপর দীর্ঘ বিরতি। ইউনিভার্সিটির শেষ দিকে আমি সিরিয়াসলি ইসলাম নিয়ে পড়াশোনা শুরু করি।
২০০৮ সালে আইসিডিতে অ্যারাবিক ল্যাংগুয়েজ ক্লাস শুরু হলো। শিক্ষক শায়খ আকরামুযযামান বিন আব্দুস সালাম। ডকটর ফা আব্দুর রহীমের মাদীনাহ অ্যারাবিক দিয়ে শুরু।
২৫ জন ছাত্র-ছাত্রী ছিলাম। ছাত্রীরা পেছনে বসত, নিকাব করে ক্লাসে আসত। উস্তাযের সাথে ঢুকত, উস্তাযের সাথে বেরিয়ে যেত। অধিকাংশ ছাত্রী ছিলেন আমার খালাম্মা বয়সী। ছাত্রদের অধিকাংশও বয়সে আমার চেয়ে বড়।
ক্লাস চলে, ছাত্র-ছাত্রী কমে।
কমতে কমতে শেষে একজন বাকী থাকল - আমি। আমরা তখন প্রথম বইয়ের শেষে।
এনাম চাচা ক্লাস বন্ধ করে দিলেন। আবার নতুন আরেকটা ব্যাচ শুরু হলো - ২০০৯ এ।
শুরুতে সবার খুব উৎসাহ থাকে - ২০ জনের ক্লাসে সিট না পেয়ে মানুষ এমনও বলে দাঁড়িয়ে ক্লাস করব।
কিন্তু সময় যায়, ছাত্র-ছাত্রী ঝরে যায়। দ্বিতীয়বার ক্লাস যখন শেষ হলো তখন আমি আর আরেকজন খালাম্মা বাকী ছিলেন।
২০১১ সালে আবার আরেকটা ব্যাচ শুরু হলো।
২০১১ সালে যখন অ্যামেরিকাতে চলে যাই তখন মাত্র ৩-৪ জন বাকী ছিল।
২০১১-১২ এক বছর মাস্টার্সের পেছনে যায়।
যারা নর্থ অ্যামেরিকান ডিগ্রি সম্পর্কে জানেন তারা হয়ত আন্দাজ করতে পারবেন এক বছরে ৩০ ক্রেডিট এর একটা মাস্টার্স শেষ করতে কী করতে হয়েছে।
কিন্তু তাও ফোর্ট ওয়েইন ইসলামিক সেন্টারে যখন নুহ নামে আজহার থেকে পাশ করা একজন ইমাম এলেন তখন প্রায় মাইল দশেক সাইকেল চালিয়ে গেলাম আরবি শিখব বলে।
রিসার্চ আর পড়ার চাপ একদিকে আর বরফ অন্যদিকে। গাড়ি নেই। বাদ হয়ে গেল আরবি শেখা।
দেশে ফিরে এসে সিয়ান পাবলিকেশনের ফাউন্ডার ম্যানেজার হিসেবে কাজ শুরু করলাম।
অফিস শুরু হতো সকাল সাতটা থেকে।
সিয়ান অ্যাকাডেমিতে কাজ করতেন উস্তায কাউসার। তিনি তখন মাত্র কাতার ইউনিভার্সিটি থেকে পড়ে দেশে ফিরেছেন।
কাউসার ভাইকে বললাম, সকাল ছয়টাতে এসে এক ঘণ্টা আরবি পড়া যায় কিনা।
কাউসার ভাই রাজি।
আমরা দু-তিনজন আবার আরবি শেখা শুরু করলাম।
সকাল ৬-৪৫ এ প্রথম বাস ছাড়ে মুহাম্মাদপুর থেকে নতুনবাজার। সাইকেল কিনে ফেললাম।
কদিন পরে দেখি আর কেউ অত সকালে আসে না। অফিসের পরে ক্লাস শুরু করলাম।
নাবিল নামে এক ভদ্রলোক ছিলেন আমাদের অফিসের বস। তিনি চাইলেন না আমরা অফিসে আরবি শিখি।
কাউসার ভাই ক্লাস নেওয়া শুরু করলেন নিকুঞ্জের একটা মাদ্রাসায়। সেখানে পড়া শুরু করলাম।
নিকুঞ্জে থাকাকালীন আতাউল মুরশেদ ভাইয়ের একটা কথা মনে গেঁথে গিয়েছিল। উনি বলেছিলেন, আমরা আরবি শেখার বাসে উঠেছি। জানি না গন্তব্যে যেতে পারব কিনা, কিন্তু বাস থেকে নামব না। আলহামদুলিল্লাহ, আমি এখনও নামিনি।
কিছুদিন হওয়ার পরে কী যেন একটা ঝামেলা হলো। ক্লাস চলে গেল আব্দুল্লাহপুর। সেখানে কয়েকদিন গিয়ে আর পারলাম না। সন্ধ্যা ছটায় নতুনবাজার থেকে উত্তরার কোনো বাসেই ওঠা যায় না।
কাউসার ভাই এরপর বনানীতে এলেন - সেখানে আবার ক্লাস শুরু করলাম। এরপর বাড্ডার শাহজাদপুরে - সেখানেও অনেক দিন।
২০১৩ থেকে ২০১৭, এইভাবে ভাঙাচোরা ভাবে কাউসার ভাইয়ের কাছ থেকে আল আসর ইনসটিটিউটে ডিপ্লোমা ইন অ্যারাবিক ল্যাংগুয়েজ শেষ হলো।
কাউসার ভাই চলে এলেন মহাখালিতে। শুরু হলো ডিপ্লোমা ইন ইসলামিক স্টাডিজে। মূল ফোকাস আরবিতে, কিন্তু পড়া চলছে কখনও তাফসির, কখনও উসুলুত তাফসির, কখনও হাদিস, কখনও উসুলুল হাদিস, কখনও উসুলুস সালাসাহ।
এখানে আকীদাহর শিক্ষক হিসেবে ছিলেন শায়খ আবু বকর মুহাম্মাদ জাকারিয়া আর হাদিস পড়াতেন শায়খ রফিকুল ইসলাম মাদানী। ক্লাসগুলো হতো বিকেল ৪ টা থেকে রাত ৮-৩০ পর্যন্ত।
কিন্তু এই শায়খদের সান্নিধ্যও থাকল না আর। শায়খরা অনেক ব্যস্ত, আর আমাদের ক্লাসে ছাত্র কমছে তো কমছেই। কাউসার ভাই আল আসরের ১২তম ব্যাচের সাথে আমাদের মার্জ করে দিলেন গতমাসে।
এখন অক্টোবর ২০১৯। উস্তায কাউসার এর কাছে বালাগাহ আর তাফসির পড়ছি। প্রতি শুক্রবার সকাল ৮ থেকে ১২ ক্লাস। আমি এই ক্লাসটার জন্য শুক্রবার কোনো ট্যুর রাখি না। খুতবা দিতে বলে অনেকে - যাই না। যদিও খুতবা না দেওয়ার মূল কারণ অযোগ্যতা, তাও, আরবি ক্লাসটার প্রায়োরিটি অনেক বেশি।
একটা ঘটনা বলি। রাজশাহীর নাবিল গ্রুপ ওদের একটা ট্রেনিং নেওয়ার জন্য বলল। এক দিনে ২০ হাজার টাকার মতো পেমেন্ট দেন উনারা। শুক্রবার করাতে হবে। বললাম, যাব না, আরবি ক্লাস আছে।
সুবহানাল্লাহ, জুন থেকে কথা বার্তা চলতে চলতে শেষে নভেম্বরে উনারা রাজি হলেন ট্রেইনিং টা শনিবার দিন নিতে। আমি শুক্রবার রাতে আরবি ক্লাস শেষ করলাম ৯টায়। রাতের গাড়িতে চলে গেলাম রাজশাহি।
যেটা রিযকে আছে সেটা আসবেই। কিন্তু আমি টাকার জন্য আমার নীতিটাকে কতটা ছাড় দিলাম এটাই আসলে দেখার ব্যাপার।
ক্লাস করব - এটাই আমার নীতি। ক্লাসে বসে যা শেখা হয় হবে। সারা সপ্তাহে একটুও পড়ি না। পরীক্ষা থাকলেও ২ ঘন্টার বেশি সময় বের করা যায় না। চেষ্টা করি, পারি না। এই ক্লাসটাই তাই আরবি শেখার শেষ অবলম্বন।
দুই দফায় আইন-শৃংখলা বাহিনীর দুটো আলাদা উইং এ হেফাজাতে থাকাকালীন সময় বাদ দিয়ে আলহামদুলিল্লাহ, কোনোভাবেই কোনো ক্লাস মিস হয়নি। আমার কাছে কেন যেন মনে হয় এই যে আমার জেদ, দাঁত কামড়ে পড়ে থাকা - এটাই আমাকে ডিফাইন করে।
নিকুঞ্জে আমার সাথে ক্লাস করেছিল - একজন দেখি এখন অনলাইনে দারস দেয়। আমি অতটা শিখতে পারিনি। কিন্তু আমি লেগে আছি। একটা আরবি হাদিস বা আয়াত পড়ে, ডিকশনারি দেখে মোটামুটি মানেটা বুঝতে পারি, একজন ক্লাসিকাল স্কলারের লেখার অনুবাদটা ঠিক হয়েছে কিনা সেটা বুঝি - এটাই আমার আপাতত বড় পাওয়া। সলাতে কুরআন তিলাওয়াতের অনেকটাই বুঝি - এটাই আমার প্রাপ্তি।
উমরাহতে গিয়ে আরব শায়খদের দারসে বসে শুনছি, কতটা বুঝছি, কতটা বুঝি না। কিন্তু যেটুকু বুঝি তাতে যে কী আনন্দ! আরবি শেখাটা ছেড়ে দিলে এই আনন্দের দেখা পেতাম কোনোদিন বলুন?
যেদিন শায়খ জাকারিয়া আরবি টাইপ করাটা ধরিয়ে দিলেন, কী যে আনন্দ হলো। আরবি বইয়ের নাম খুঁজতে খুব ঝামেলা হতো। এখন নিজেই সার্চ দিই, বইয়ের দরকারি অংশটুকু দেখে নিই। শায়খের শেষ ক্লাসের নোটটা পুরোটাই আরবিতে তোলা!
এই লেখাটা আসলে অনুরোধের লেখা। আরবি শেখার ওপরে একটা বই বের হবে সেটার জন্য। এই কথাগুলো বলা শুধু তাদের জন্য যারা আরবি শেখার চেষ্টাটা ছেড়ে দিয়েছেন।
ভাইয়েরা, আপনি আরবি পারলে জান্নাতে যাবেন, না পারলে যাবেন না - এমনটা হয়ত না। কিন্তু আপনি আল্লাহর কাছে বলতে পারবেন, মালিক, আপনার শব্দগুলো বোঝার জন্য আমি কতটা চেষ্টা করেছি এটা আপনি জানেন। আমাকে এই উসিলায় মাফ করে দেন।
আল্লাহ যে আসলে এই জিদটা দিয়েছেন, আর্থিক-আত্মিক-দৈহিক সামর্থ্য দিয়েছেন, শেখার একটা জায়গা দিয়েছেন, ভালো শিক্ষকদের ব্যবস্থা করে দিয়েছেন - সব কিছুর জন্য সব প্রশংসা, সব কৃতজ্ঞতা তার জন্যই। আলহামদুলিল্লাহ। আমার আরবি শেখার এই প্রচেষ্টার তাওফিকও যে আল্লাহই দিয়েছেন - এটা একটা অ্যামাজিং ব্যাপার।
আমাদের রব তো এমনই। তিনি আমাদের ভালো কাজ করার তাওফিক দেন, সুযোগ দেন - আবার সেই ভালো কাজ করার কারণে পুরষ্কারটাই দেন।
আমি তলিবুল ইসলাম হতে পারব না, এই যোগ্যতা আমার নেই। কিন্তু আল্লাহর কালাম শেখার জন্য যে প্রচেষ্টা এর দাম পৃথিবীর অন্য কিছু দিয়ে হয় না। আল্লাহ যদি এটুকু কবুল করে নেন, আর কিচ্ছু চাই না।