খুব প্রিয় একটা ছোটভাইকে আজকে আমার রুমে এনেছিলাম। কোনো একদিন তাকে বলেছিলাম, আমরা যতই গোনাহ করি, আল্লাহর সামনে অশ্রু ঝরানোটা যেন বন্ধ না করি। কুরআন পড়ে অথবা শুনে নিজের ভেতর কান্নার আবহ তৈরি করার কথা বলেছিলাম। এই কথাটা শুনতে যথেষ্ট ক্লিশে মনে হওয়া স্বাভাবিক। অবাস্তব পরামর্শ মনে হওয়াও অস্বাভাবিক নয়। ওটা তার বলা লাগেনি, আমি তার চেহারার এক্সপ্রেশনেই আন্দাজ করেছি, সে কী বলতে চায়। ম্যাটেরিয়ালিস্টিক প্যারাডাইমে দিন কাটিয়ে আমরা এমনিতেই রূহানিয়তের বারোটা বাজিয়েছি, ইন্টেলেকচুয়াল জিমনেস্টিক-এর সঙ সেজে দ্বীনি আবেগ আর সমর্পণের অনুভূতিকে অর্থহীন জ্ঞান করতে শিখেছি, কুরআন বুকে নিয়ে কাঁদাকে প্রগলভতা মনে হওয়া আমাদের কাছে তো একেবারে স্বাভাবিক। আজ কাকডাকা ভোরেই তাকে একপ্রকার জোর করে রুমে ডেকে এনেছি একটা দৃশ্য দেখানোর জন্যে। কোন দৃশ্যটা কেন দেখাতে চেয়েছি, গল্পটা বলতে চাই।
শেষবিচারের কঠিন মুহূর্তে আল্লাহর আরশের ছায়াতলে অনেক সৌভাগ্যবান মানুষ ঠাঁই পাবেন। এঁদের মধ্যে বিশেষভাবে সাত ধরনের মানুষের কথা একটা হাদিসে এসেছে। হাদিসটা বহুলপঠিত ও সমধিক পরিচিত। সকল যুগেই আল্লাহভীরু মানুষেরা এই সাতটা বৈশিষ্ট্যকে জীবনের নানা পর্যায়ে চেকলিস্ট বানিয়ে দেখেছেন। আমরাও দেখতে পারি। এই সাত ক্যাটাগরির মধ্যে সম্ভবত সবচেয়ে সহজ কাজ হলো শেষটা। (ورجل ذكر الله خالياً ففاضت عيناه — সেই লোক, যে আল্লাহকে নির্জনে স্মরণ করে, তারপর তার চোখে অশ্রু ঝরে।) এই কাজটা আম্বিয়া আলাইহিমুস সালাম এবং সালিহীনদের জন্যে সহজ ও সহজাত। আমরা গোনাহগারদের জন্যে একটু কঠিন। আমাদের অন্তর অতটুকু কোমল নয়, যতটুকু কোমলতার ছোঁয়া পেলে চোখ ভিজে যায়। আমাদের ঈমান অতটা শক্ত নয়, যতটা শক্তির অভিঘাতে পাথরের বুকে ঝরনা নামে। কিন্তু এই পাথরকঠিন হৃদয়কে বিদীর্ণ করার একটা হাতিয়ার আমাদের কাছে আছে। নাম তার কুরআন। আল্লাহ জানাচ্ছেন, আম্বিয়া ও সালিহীনদের অশ্রুপাতনের পেছনেও অনুঘটকের ভূমিকা রাখতো কুরআন। [দ্রষ্টব্য ১৯:৫৮] কুরআনের যে অংশটাই পাঠ করা হোক, সেই পাঠের সাথে ভালোবাসার সংযোগ ঘটলে অন্তর নরোম হতে শুরু করে। অশ্রু না আসুক, অন্তত অশ্রুপাতের জন্যে কিছু মেঘ ঘন হতে শুরু করে। পঠিত অংশের মর্ম অনুধাবনের চেষ্টা করলে ভালোবাসার সংযোগ ঘটানো সহজ হয়। মাঝেমধ্যে চেষ্টা করে দেখতে পারেন। নিজে পাঠ না করে অন্যের পাঠ (তিলাওয়াত) শোনাটাও এক্ষেত্রে সমান কার্যকরী। আমাদের নবিজি (সা) তাঁর স্নেহধন্য আবদুল্লাহ ইবন আব্বাস (রা)-কে কুরআন পাঠ করে শোনাতে বলেছেন, শুনতে শুনতে শ্মশ্রু ভিজিয়ে অশ্রু ঝরিয়েছেন; হাদিসের পাতায় তার অনেক নজির আছে। কাজেই, কুরআন শুনে কান্না করা সুন্নাহও বটে। এটাকে ছোট করে দেখবেন না। পছন্দের কারী’র তিলাওয়াত শুনে কাঁদতে পারাটাও বিশাল সৌভাগ্যের বিষয়, আল্লাহর কাছে কৃতজ্ঞ হবার মতো নেয়ামত। যাঁরা এটা পারেন, শোকরগুজার হোন। আমরা যাঁরা পারি না, আসেন, বুকে হাত চেপে আল্লাহকে বলি — আরশের মালিক, আমাকে একফোঁটা অশ্রু ভিক্ষা দেন; আমার কান্না আসে না, আমাকে কাঁদার সুখানুভূতি দেন। সালাফদের মধ্যে একজনের গল্প শুনেছিলাম আব্বুর কাছে। তাঁর নামটা ভুলে গিয়েছি। তিনি অনেকদিন ধরে অনুভব করছেন, তাঁর অন্তর কঠিন হয়ে গেছে। তাঁর এক প্রিয় উস্তাযের কাছে গিয়ে বললেন, আমার অন্তর কঠিন হয়ে গেছে, আমাকে এর প্রতিকার দেখিয়ে দেন। উস্তায পরামর্শ দিলেন, তুমি আল্লাহর কাছে কাঁদো। লোকটি বললেন, আমার তো কান্না আসে না। উস্তায বললেন: তবুও কাঁদো। ‘আমার কান্না কোথায় হারিয়ে গেল’ বলে বলে কাঁদো। ‘আল্লাহ আমার কান্না আসে না, আমাকে কান্নার সৌভাগ্য দাও’ বলে কাঁদতে থাকো। ব্যস, ততক্ষণে লোকটার চোখ ভিজে গেছে।
কিন্তু যত সহজে কান্নার কথা বলা হচ্ছে, এত সহজে কি আসলেই কাঁদা যায়? ওর চোখেমুখে এমন প্রশ্নের প্রচ্ছন্ন ছাপ দেখে আজকে তাকে রুমে এনেছি। আমার রুমমেট মর্নিং ওয়াক শেষ করে রুমে এসেছে। এসেই কানে গুঁজে দিয়েছে রবীন্দ্রসঙ্গীত।একটু পরপর দুয়েক কলি নিজেও আওড়াচ্ছে। মিনিট কয়েক পরেই কান্নার সুর। দরদর করে অশ্রু ঝরানো কান্না নয়, চোখ ছলছল করা কান্নাও নয়। কিন্তু গানের সাথে অনুভূতিকে একাকার করে যে রোদনধ্বনি তার অন্তরে ঢেউ খেলছে, আওড়ানোর সময় সেটা স্পষ্টই বোঝা যাচ্ছে। দুই বছর ধরে এতগুলো রুমমেট চেষ্টা করে তাকে মসজিদে নিতে পারিনি, রুমে কাতারবন্দী জামাআতের কিরাআত তাকে কখনও ছুঁতে পারেনি, কিন্তু রবীন্দ্রসঙ্গীতের আবেদন তাকে এতটাই স্পর্শ করেছে যে, প্রায়ই আবেগতাড়িত হয়ে পড়তে দেখি। সেই আবেগ মাঝেমাঝে লঘু কান্নায় পর্যবসিত হয়। অথচ তার মতো কাষ্ঠকঠিন হৃদয়ের মানুষ আমি কম দেখেছি। কারণটা কী? ভালোবাসা ও আবেগের সংযোগ যেখানে পুরোপুরি ঘটে, অনুভূতির সাথে লেনাদেনা যেখানে নিখাদ হয়, মোহাচ্ছন্নতা যেখানে ঠাঁই নিতে বাধ্য, নীরব অশ্রুপাতন সেখানে নিতান্তই সহজসাধ্য। কুরআনের সাথে আমাদের সম্পর্কটা দায়সারা বলে, কুরআনকে বুকের মধ্যিখানে জায়গা করে দিতে পারিনি বলে কুরআন-পাঠোত্তর কান্নার সুখ পাই না, কুরআন-শ্রবণোত্তর অশ্রুপাতের স্বাদ নিতে সাধ জাগে না। আশা করি আমার ভাই এই মর্মে কনভিন্সড যে, অশ্রু ঝরানো কোনো কঠিন কাজ নয়। অন্তরের কাঠিন্য কিংবা পাপবোধের ঊর্ধ্বে একটা উন্মুক্ত আকাশ আছে, যেখানে ওড়ার অধিকার আল্লাহ সবাইকে দিয়েছেন। সেই আকাশের নাম অশ্রু। ওড়ার সাহস করলেই তার নাগাল পাওয়া যায়।
প্রশ্ন করুন: ‘নজীব! এত গল্প করার কারণ কী? বুড়ো বয়সে এসে কান্না করার মতো বাচ্চামোর দিকে প্ররোচিত করার জন্যে এত উৎসুকই বা কেন?’
একটা কারণ তো অলরেডি জেনেছেন; আরশের নিচে ছায়া পাওয়ার স্বপ্ন যেন হাতছাড়া না হয়। আরও দুটো কারণ স্মরণ করিয়ে দিতে চাই।
[১] নির্জনতা শয়তানের আক্রমণস্থল। একাকী থাকা অবস্থায় নফসের প্ররোচনা বেশি সক্রিয় হয়। পাপ না করলেও নিদেনপক্ষে পাপের চিন্তা মাথায় আসার শংকা থাকে। ইমাম ইবনুল কাইয়িমের মতে, আমরা যেসব আনডিফাইনড বিষণ্নতায় ভুগি, সেসবের মূল কারণ হলো আনডান পাপচিন্তা। নির্জনে কুরআন পড়া অথবা শোনার স্বাদ পেতে থাকলে এবং অশ্রুপাতের অভ্যাসে নিয়মিত হতে পারলে এই ঝুঁকি থেকে মুক্ত থাকা যায়।
[২] নবিজি (সা) বলেছেন: "عينان لا تمسهما النار: عين بكت من خشية الله، وعين باتت تحرس في سبيل الله"
“দুইটি চোখকে কখনোই জাহান্নামের আগুন স্পর্শ করবে না — আল্লাহর ভয়ে যে চোখ কাঁদে এবং আল্লাহর রাস্তায় যে চোখ রাতজেগে প্রহরায় নিয়োজিত থাকে।” [তিরমিযি]
পাহাড়-সমান পাপের সামান নিয়ে অপরাধীর বেশে আল্লাহকে যেন বলতে পারি, আমাকে আগুনে ফেলে দিয়েন না মালিক! আমার এই চোখ অন্তত কয়েকবার তো আপনার ভয়ে কেঁদেছিল। আমাকে রহম করেন প্রভূ, আমার পাপের দাগ ঐ কয়ফোঁটা অশ্রু দিয়ে মুছে দেন।