[১]
শেষ রাত্রির গল্পের আসরে আপনাকে স্বাগত জানাচ্ছি। আমরা গল্প করবাে, ফাঁকে, ফাঁকে কিছু কথাও বলবাে।
প্রথম গল্প শােনার আগে
এক
ধরুন, আপনি কাউকে ভালােবাসেন। খুব, খুউব ভালােবাসেন। আবেগসিক্ত অনুরাগে হৃদয়ে প্রীতিময় দ্যোতনা সৃষ্টি করেন। ভেবে দেখুন তাে, আপনার অনেক অনেক প্রিয় ভালােবাসার মানুষটির সাথে আপনি কখন কথা বলবেন? হৃদয়ের অব্যক্ত অনুভূতিগুলাে কখন ব্যক্ত করবেন? নিশ্চয়ই একান্তে! তাই না? কোলাহলমুক্ত নিভৃত কোন সময়ে আপনি মন উজাড় করে দিতে পারেন তাকে।
দুই
আপনি বলে থাকেন, 'আমি আল্লাহকে সবকিছুর চেয়ে বেশি ভালােবাসি'। তা-ই যদি হয়, সমস্ত বিশ্ব চরাচর যখন নিঝুম রজনীতে ঘুমের কোলে ঢলে পড়ে, নিঃশব্দের ঢেউ খেলে যায় প্রকৃতির বুকে, নীরবতার ছায়া নেমে আসে পৃথিবীর আঙিনায়; তখন কি ইচ্ছে করে আপনার প্রিয়তম মালিকের সাথে একটু নিভৃতে কথা বলার? হৃদয়ের জমানাে ব্যথাগুলাে তাঁর কাছে পেশ করার? ইচ্ছে করে আপনার প্রেমাস্পদকে ভালােবাসার দু-ফোঁটা অশ্রু নিবেদন করার? সমস্ত সৃষ্টি যখন সুখনিদ্রায় বিভাের, তখনই তাে প্রিয়তম স্রষ্টার সাথে একান্ত আলাপনের সুবর্ণ সুযােগ!
প্রথম গল্পটি:
গল্পটি আমার এবং আপনার মতােই দু জন ব্যক্তির! আমাদের মতােই রক্তে-মাংসে গড়া দু জন বিশ্বাসী মানুষের! শুনুন তবে:
হুসাইন ইবন আল-হাসান রাত্রিকালীন সালাতের ব্যাপারে একটু উদাসীন ছিলেন। তাই ফুদাইল ইবন ‘ইয়াদ একবার হুসাইনের হাত ধরে দৃষ্টি আকর্ষণ করে কথা বলেছিলেন। সে কথা হৃদয়ের খুব গভীরে রেখাপাত করার মতাে।
শােনাে হুসাইন! আল্লাহ পূর্ববর্তী অনেক কিতাবে বলেছেন, “যে আমার ভালােবাসা দাবী করে, সে মিথ্যা বলে। যখন রাত নেমে আসে, সে আমাকে ফেলে (কিভাবে) ঘুমিয়ে থাকে! আচ্ছা, প্রত্যেক প্রেমিকই কি তার প্রেমাস্পদকে নিভৃতে পেতে চায় না?” [আল-মুজালাসাহ: ১৩২]
আপনার অবস্থান?
আপনি ইতােমধ্যেই বুঝতে পেরেছেন, আপনার দাবিতে আপনি সত্যবাদী কি-না। যদি ইতিবাচক উত্তর হয়, আপনি আল্লাহর কৃতজ্ঞতা ও শুকরিয়া আদায় করুন এবং ধারাবাহিকতা ঠিক থাকার জন্যে আল্লাহর কাছে দু’আ করুন।
যদি নেতিবাচক উত্তর হয়, চলুন না, আজ থেকেই সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলি, আমি আমার ভালােবাসার দাবীকে সত্য প্রমাণ করবােই ইনশা-আল্লাহ!
আল্লাহ আপনাকে তাওফিক দিন।
থামুন, আপনার জন্যে আরাে কিছু গল্প এখনাে বাকী!
দ্বিতীয় গল্প বলার আগে
আপনি এরই মধ্যে একটি হাদিস প্রায় সময়ই শুনে আসছেন। হ্যাঁ, ঠিক ধরেছেন, আবু হুরায়রার [রা.] বর্ণিত হাদিসটার কথাই বলছিলাম!
রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেন:
ফরয সালাতের পরে (মর্যাদা ও ফযিলতের দিক থেকে) সর্বোত্তম হােল শেষ রাতের সালাত। [মুসনাদ আহমাদ: ৮৪৮৮]
অতঃপর কী হলাে?
হাদিসটি শােনার পর আপনার বিশ্বাসের জমিনে ইচ্ছার বীজ বপন করে ফেললেন। ‘আমাকেও এই সালাতে শামিল হওয়া দরকার!'
এর সাথে সাথে জেনে ফেলেছেন শেষ রাতের সালাতে অভ্যস্তদের জন্যে আল্লাহর কাছে সুমহান মর্যাদার কথাটাও। ঐ যে, ইবন 'আব্বাস [রা.] যে হাদিসটা বর্ণনা করেছিলেন!
রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন:
আমার উম্মতের মধ্যে সবচেয়ে সম্মানিত হােল কুরআনের ধারক-বাহক এবং রাত্রিতে ‘ইবাদাতকারীগণ [শু’আব আল-ঈমান: ২৯৭৭]
এবার তাে আরাে চমৎকার একটা হাদিস পড়ে ফেললেন! জাবির [রা.] বর্ণনা করেছেন যেটা! রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন:
"তােমাদের উচিত রাত্রিকালীন সালাত (তাহাজ্জুদ) আদায় করা। কারণ, তা-
- তােমাদের পূর্ববর্তী সালিহ বান্দাহদের অভ্যাস,
- আল্লাহর নৈকট্য অর্জনের মাধ্যম,
- পাপ থেকে রক্ষাকারী,
- মন্দ ‘আমাল সমূহের অপনােদনকারী,
- শরীর থেকে রােগ-ব্যাধি উপশমকারী” [সুনান আত-তিরমিযী: ৩৫৪৯]
তারপর?
আপনার সুপ্ত বাসনার অঙ্কুরােদগম হলাে। মােটামুটি স্থির হলেন। আত্মবিশ্বাসের পারদ হয়ে গেলাে উর্ধ্বগামী। কিন্তু বাধ সাধলাে আরেকটা সমস্যা। আপনি ঘুম থেকে জাগতে পারছেন না!
আপনার জন্যে দ্বিতীয় গল্পটা
ঠিক এমনই অভিযােগ নিয়ে একজন ব্যক্তি হাসান আল-বাসরী’র [র.] কাছে এসেছিলেন। লােকটি বলেছিলেন, “আমি অনেক চেষ্টা করেও রাত্রে তাহাজ্জুদের জন্যে ঘুম থেকে জাগতে পারি না। আমার জন্যে কী প্রতিষেধকের পরামর্শ দেবেন?”
হাসান আল-বাসরী খুব অল্প কথায় তাকে সমাধান দিয়েছিলেন:
তুমি দিনের বেলায় পাপ কাজ থেকে দূরে থাকো, তাহলে রাতের বেলা সালাতের জন্যে জাগ্রত হতে পারবে। রাত্রে সালাতে দন্ডায়মান হওয়াটা অনেক বড় মর্যাদার ব্যাপার। আর পাপীকে কখনাে এই মর্যাদা দেওয়া হয় না।
অল্প কথা। কিন্তু ওজনটা কতটুকু ভারী, চোখ বন্ধ করে কেবল অনুভব করা যায়। নয় কি?
চূড়ান্ত গল্পগুলাে
আপনি মানসিক ভাবে প্রস্তুত। আপনার দিনটি আল্লাহর সীমারেখা অতিক্রমের কোনাে ছােট উপলক্ষেরও সাক্ষাৎ পায় নি। আলহামদুলিল্লাহ। এই তাে! এ-ই তােওও! আপনি সফল। অভিনন্দন! আপনার জন্যে চূড়ান্ত গল্পের ডালি নিয়ে আমরা অপেক্ষমাণ। তার আগে কিছু পরামর্শ আপনার জন্যে,
» খুব বেশি নয়, আপনি মাত্র আধ ঘন্টার প্ল্যান নিয়ে শুরু করুন।
» মনটাকে শক্ত করে ফেলুন। আত্মবিশ্বাস রাখুন। আল্লাহর ওপর আস্থা রাখুন।
» প্রাথমিক ভাবে প্রতিদিন হয়তাে সম্ভব হবে না। কোন্ কোন্ দিন আপনার পক্ষে সম্ভব হচ্ছে, আগেই তা ঠিক করে ফেলুন।
» ব্লগ বা ফেসবুকে অধিক আসক্তি থাকলে আপনার নিজের কল্যাণের জন্যেই | সেসবের নিয়েন্ত্রিত ব্যবহারে অভ্যস্ত হওয়া অনেক বেশি প্রয়ােজন। তাহাজ্জুদের সুমহান নেয়ামত পেতে হলে তাে সময় অপচয়কারী এ বিষয়গুলাে কড়া নিয়ন্ত্রণে আনার বিকল্পই নেই।
» অযু করে যথাসম্ভব তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়ুন। আল্লাহর ওপর ভরসা করে অ্যালার্ম দিয়ে রাখুন।
» পর্যায়ক্রমে (ইন শা-আল্লাহ) নিয়মিত অভ্যস্ত হবার চেষ্টা করুন।
তৃতীয় গল্পটি
এই গল্পটা অনেক অ-নে-ক বেশি প্রেরণাদায়ক। আপনার সাথেও হয়তাে মিলে যেতে পারে!
‘আব্দুল আযীয ইবন আবি রাওয়াদ ছিলেন আমাদের মতােই আরেকজন বিশ্বাসী মানুষ। তিনি শেষরাত্রে সালাতের জন্যে উঠতে চাইলে কোমল ও আরামদায়ক বিছানার পরশে কিছুটা পিছুটান অনুভব করতেন।
তারপর কী করতেন জানেন?
বিছানায় হাত বুলাতে বুলাতে বলতেন, ওহ! কতাে নরম আর আরামদায়ক তুমি! কিন্তু জান্নাতের বিছানাটা যে তােমার চেয়েও অধিক কোমল আর আরামদায়ক।
অতঃপর তিনি সালাতে দাঁড়িয়ে যেতেন।
সর্বশেষ গল্প শােনার আগে
আচ্ছা, আপনি অনেক খুশি না? আরে আরে, মুচকি হেসে কী লাভ? বলেই ফেলুন, আমরাও একটু শুনি! আপনার হৃদয়ে প্রশান্তির সুশীতল বাতাস স্পর্শ করে যাচ্ছে কী নির্মল স্নিগ্ধতায়! কিন্তু আমি আপনাকে স্বার্থপর বলি, তা নিশ্চয়ই চান না। আপনি যদি ভাইয়া হয়ে থাকেন, তাহলে আপুকে বঞ্চতি করবেন কেননা? আর আপুরাই বা কেননা ভাইয়াকে ফেলে সৌভাগ্যের অংশীদার হবেন? চলুন না, দুজনের ভালােবাসার পদ্ম দুটো আল-ওয়াদূদের চূড়ান্ত ভালােবাসার মৃণালেই ফুটিয়ে তুলি!
[২]
আজ থেকে প্রায় দেড় বছর আগে তাহাজ্জুদ নিয়ে দুইটা লেকচার শুনেছিলাম[1]। লেকচার থেকে দুইটা ব্যাপার শুনে আমি এত বেশি শকড হয়েছিলাম যা আগে কখনো হইনি-
১. তাহাজ্জুদ একটা সম্মান যা গুনাহগারদের আল্লাহ দেন না।
২. আল্লাহ কার প্রতি কতটা সন্তুষ্ট তা বুঝতে হলে দেখুন কে কতটুকু তাহাজ্জুদ নিয়ে সিরিয়াস। ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল(রহি) বলেছেন- 'যে তাহাজ্জুদ পড়েনা আমি তাকে ধার্মিকতার কাতারেই ফেলিনা।'
সেদিনের পর থেকে নিজের উপর এক্সপেরিমেন্ট চালানো শুরু করলাম। টানা প্রায় দেড় বছর সেই এক্সপেরিমেন্ট চালানোর পর আমি একটা সুত্র আবিস্কার করেছি। আবিস্কার বললে ভুল হবে, অনুধাবন বলা যায়। সুত্রটা হল-
>>⏳যথাযথভাবে তাহাজ্জুদ পড়তে পারার হার হৃদয়ের কাঠিন্যের ব্যাস্তানুপাতিক।
ব্যাখ্যাঃ তাহাজ্জুদ পড়তে পারবো কি না এইটা আমি ঘুমাবার সময়ই এখন বুঝতে পারি নিজের হৃদয়ের অবস্থা দেখে। দিনের বেলায় করা প্রতিটা কাজকর্মই ডিফাইন করবে আপনি রাতে তাহাজ্জুদ পড়তে পারবেন কি না। আবার পারলেও কতটুকু আন্তরিকতা আসবে সেটাও বুঝতে পারবেন। আপনার হৃদয় যত বেশি নম্র হবে তাহাজ্জুদে তত বেশি হৃদয় পরিতুষ্ট হবে,চোখে পানি আসবে।
আর কার অন্তর কত বেশি নম্র তা নির্ভর করে কে কতবেশি তাকওয়াবান। যত বেশি আল্লাহর আনুগত্য করবেন,গুনাহ থেকে বেচে থাকবেন- তত বেশি অন্তরটা নরম হবে। অন্যদিকে যত বেশি বেহুদা কাজকর্ম গুনাহ ইত্যাদি অবাধ্যতায় লিপ্ত থাকবেন,ইবাদত থেকে বিমুখ থাকবেন তত বেশি অন্তর কঠিন হবে। আর সেই কঠিন অন্তর নিয়ে রাতে উঠতে পারবেন না। উঠতে পারলেও সালাতে দাড়াতে পারবেন না। সালাতে দাড়াতে পারলেও চোখ দিয়ে পানি আসবেনা। আমার অভিজ্ঞতা থেকে এমনও দেখেছি-
❎ রাত ৯টায় ঘুমিয়েছি, এলার্ম দিয়েছি ৫-৬ টা। কোনভাবেই চান্স নাই মিস হওয়ার। তারপরেও পারিনি নামাজে দাড়াতে। এমনকি জাগনা পেয়েও পড়তে পারিনি। কখনো আবার পড়তে পারলেও আলসেমি,কোন ফিলিংস নাই, চোখে পানি নাই...কারন একটাই- কঠিন হৃদয়।
✅ আবার এমনো হয়েছে যে প্রচন্ড হার কাপানো শীতে ঠান্ডা পানি দিয়ে ওজু করে নামাজে দাড়িয়েছি- চোখ দিয়ে গড়গড় করে পানি পড়ছে। কি এক প্রশান্তি যা বলার বাহিরে। কারন একটাই- নরম হৃদয়। আফসোসের বিষয় এরকম রাত পেয়েছি বিগত এক বছরে হাতে গনা কয়েকটা। বেশিরভাগ রাত কাটে এমন যে ফজরে জাগ্না পেয়ে তাহাজ্জুদ না পড়ার আফসোস করতে হয়।
উপসংহারঃ আমি যে কতটা নিকৃষ্ট আল্লাহর গোলাম তা তাহাজ্জুদ পড়ার চেস্টা না করলে বুঝতেই পাড়তাম না। এইটা অনেকটা লিটমাস টেস্টের মত। আপনিও যাচাই করে দেখতে পারেন- আল্লাহ আপনার প্রতি কতটা সন্তুষ্ট। মনে রাখবেন- কেবল ঘুমের প্যাটার্ন দিয়ে তাহাজ্জুদ হয়না- তাহাজ্জুদ হয় আপনার দিনের কাজকর্ম দিয়ে। দিনটা যত গুনাহমুক্ত থাকবেন,রাতে তত নরম হৃদয়ে আল্লাহর সামনে দাড়াতে পারবেন।
[1] বিস্তারিত জানতে নিচের লেকচার দুইটা শোনার অনুরোধ রইলো-
১. https://youtu.be/E0-GqjuDevs
২. https://youtu.be/HojZTLyONOk
প্রথম প্রবন্ধটি *আব্দুল্লাহ মাহমুদ নজীব* ভাইয়ের *শেষরাত্রির গল্পগুলো* বই থেকে নেওয়া
দ্বিতীয় প্রবন্ধটি লিখেছেন *শামস আল রিফাত* ভাই