১.
কলেজ যাওয়ার পথে রোজই ক্যান্টঃ এর ভিতরে মাথা নুয়ে থাকা গাছগুলো চোখে পরে। যেখানে গাছের ডালগুলো হবে আকাশের দিকে ঊর্ধ্বগামী, পাতাগুলো হবে সতেজ, দুরন্ত,প্রাণবন্ত, আর বাতাসের তালে দোল খাওয়া, সেখানে ক্যান্টঃ এর গাছগুলো দেখলে মনে হয় প্রাণহীন, নির্জীব, আবেগহীন, আবদ্ধ। দেখে মনে হবে গাছগুলো অনেক কিছু বলতে চাইছে, বাতাসের তালে দোল খেতে চাইছে কিন্তু কে যেনো আটকে রেখেছে খুব শক্ত করে, আবেগগুলকে বের হতে দিচ্ছে না, আকাশের দিকে তাকাতে দিচ্ছে না। যদি এই গাছগুলোর ছোটকালের জীবনটা দেখা হয় তাহলে দেখা যাবে, চারা অবস্থায় থাকতে তাদের পলো দিয়ে ঢেকে রাখা হতো যেন চারাগুলো বড় হওয়ার সময় তার ডালগুলো এদিক-ওদিক না গিয়ে একটা নির্দিষ্ট শেপে বড় হয়। আর তাই গাছগুলো যখন বেড়ে ওঠে তখন তাদের মাথায় ওপরে পলো না থাকা সত্বেও তারা মাথা উঁচু করে দাড়াতে পারেনা। তাদের আবেগকে প্রকাশ করতে পারে না।
২.
খুব ছোট বাচ্চাদের দেখবেন সবার সামনে কাঁদতে দ্বিধাবোধ করে না, তাদের মনে যত কষ্ট আছে কত সহজেই না তারা সেটা প্রকাশ করে দেয় কান্নার মাধ্যমে। কিন্তু সে যখন আস্তে আস্তে বড় হয় তখন তার এই আবেগ প্রকাশের সহজাত আচরণকে আমরা হাসি-ঠাট্টা, ধিক্কার, লজ্জা কখনও বা ভয় দেখিয়ে বাঁধা দেয়ার চেষ্টা করি। তাকে বলি “ছি ছি, সোনা সবার সামনে এভাবে কেউ কাঁদে?” “লোকে কি বলবে” “তোমার ফ্রেন্ড কি বলবে?” “ওকে দেখো কি লক্ষ্মী মত আছে, ওকি তোমার মত কান্না করছে?” তার ছোট ছোট বন্ধুরা তাকে দেখিয়ে একে অপরের দিকে ইশারা করে বলে “দেখ দেখ, ও না কাঁদতিসে, হি হি হি”। বলতে গেলে এক লজ্জাজনক পরিবেশ সৃষ্টি করে আদুরে ভাব নিয়ে বাচ্চার কান্না থামানোর চেষ্টা করা হয়। বাচ্চারা এই সহজাত আবেগ প্রকাশ করতে বারবার বাঁধা পেতে পেতে একসময় সে সবার সামনে সেই নিষ্পাপ বাচ্চার মত আর কাঁদতে পারে না। কারণ সে দেখেছে সবার সামনে সহজাত আবেগকে প্রকাশ করলে মানুষ তাকে নিয়ে হাসাহাসি করে, লজ্জা দেয়, বকা দেয়, দুর্বলভাবে। তাই সে আর সবার সামনে কাঁদে না, কাঁদে লোকচক্ষুর আড়ালে এবং তার কষ্টগুলো প্রকাশ করে না, চেপে রেখে দেয় নিজের ভেতরেই। কারণ সে সবার সামনে সিনক্রিয়েট করতে চায় না, লজ্জা পেতে চায় না, নিজেকে দুর্বলভাবে প্রকাশ করতে চায় না।
৩.
আমাদের মাঝে এমন অনেকেই আছে যারা আজ মন খুলে কাঁদতে পারিনা। যখন মসজিদে কিংবা বাসায় সালাতরত অবস্থায় থাকি তখনও নিজেদের কষ্টকে প্রকাশ করতে ইতঃস্তত বোধ করি এইভেবে যে “লোকে কি ভাববে?” আমরা লজ্জা পাই কারো কষ্টে কাঁদতে, নিজেদের কষ্টকে প্রকাশ করতে কারো কাছে। জীবনযাপন করি এক রোবোটের মতো যার কোন আবেগ নেই। আর মাঝরাতে তাহাজ্জুদের সালাতে দাড়িয়ে আল্লাহকে প্রশ্ন করি “আমার কান্না পায়না কেন?”। মনে অনেক কষ্ট আছে নিজের রবকে বলার জন্য। কিন্তু বলার জন্য সেই আবেগ নেই। নিজের রবকে নিজের কষ্টগুলো বলতে গেলে মনে হয় চোখ দুটো পাথরে পরিণত হয়েছে আর হৃদয়টা মরুভূমিতে। এমনকি আমাদের মধ্যে এমন অনেকেই আছি যারা নিজেদের পরিবার, ভাইবোনদের সাথে দুঃখটাকে শেয়ার করতে পারলেও আবাগটাকে শেয়ার করতে পারিনা।
আমাদের লজ্জা লাগে। কেন? কারণ কিছুক্ষণ পর বা কিছুদিন পর তারাই আমাদের নিয়ে হাসাহাসি করবে,মজা করবে, লজ্জা দিবে। অন্যদের ক্ষেত্রে আমারাও ঐ একই কাজ করি। তাই যখনই নিজেদের আবেগটাকে প্রকাশ করতে চাই তখনই আমাদের মনে আসে খালি একটা কথা “লোকে কি ভাববে?”। এমনকি সালাতরত অবস্থায় যখন নিজের রবের সাথে নিজের কষ্টগুলো শেয়ার করি তখনও আশেপাশে মানুষ থাকা অবস্থায় আমরা কাঁদতে পারিনা। কাঁদার সেই স্বাধীনতাটা বোধ করিনা। কারণ ছোটকালেই কাঁদার সেই স্বাধীনতাটার টুঁটি চেপে ধরা হয়েছে।
সালাতে বা মোনাজাতে আল্লাহর কাছে নিজের আবেগ প্রকাশের সময় আরেকটা কথা মাথায় আসে “রিয়া হচ্ছে নাতো?”। রিয়া যেন না হয় সেই চেষ্টা করতে গিয়ে আমরা আমাদের নিয়তটাকে পরিশুদ্ধ রাখার জন্য আমাদের কষ্ট প্রকাশকেই রবোটিক করে দেই। এ এক অসহ্য যন্ত্রণা। আর “রিয়া হচ্ছে না তো?” এই কথা টা মনে আসবে নাই বা কেন? যখন একজন সালাতে থাকা অবস্থায় কান্না করে তখন আশেপাশের সবাই সালাত শেষে তার তাকওয়া, নরম মন, ইনোসেন্স এর প্রশংসা শুরু করে দেয় তার সামনেই। যখন রাসুল (সাঃ) বলেছেন- “তোমরা তোমাদের ভাইয়ের সামনে তার প্রশংসা করো না কারণ এটির মাধ্যমে তার মেরুদন্ড ভেঙ্গে দেয়া হয়”, সেখানে আমরা করি তার উল্টোটা। আর তাই এই লজ্জায় অনেকে সালাতে আর কাঁদতে পারেনা।
৪.
আবু বাকর (রা)- দুনিয়ার বুকে হেঁটে যাওয়া নবী-রাসুলদের পর সর্বশ্রেষ্ঠ ব্যক্তি। তিনি যখন সালাতে দাঁড়াতেন তখন তার কান্না থামাতে পারতেন না। রাসুল (সাঃ) যখন মৃত্যুশয্যায় শায়িত তখন মা আয়েশা (রাঃ) - কে বললেন আবু বাকার (রাঃ) কে বলতে সালাতের ইমামতি করার জন্য। কিন্তু আয়িশা (রাঃ) রাসুল (সা)- কে বললেন “ইয়া রাসুলল্লাহ, তিনি খুব নরম মনের মানুষ, আমার মনে হয় না তিনি সালাতে ইমামতি করতে সক্ষম হবেন”।
উমার (রা)- সাহাবীদের মধ্যে সবচেয়ে কঠিন মনের মানুষ ছিলেন। যাকে দেখলে শয়তান-ও ভয় পেয়ে নিজের পথ বদলাতো, সেই তিনি যখন তার রবের সামনে দাঁড়াতেন, তখন বাচ্চাদের মত কাঁদতেন। রাসুল (সাঃ) এর পিঠে চাটাইয়ের দাগ দেখে ডুকরে কেঁদে উঠতেন। যখন বিলাল (রাঃ) আল-আকসা বিজয়ের পর সেখানে আযান দিলেন তখন, “আশহাদু আন্না মুহাম্মাদার রাসুল্লল্লাহ” আসতেই উমার (রাঃ) কেঁদে দিলেন। তার কান্নার তীব্রতা এত বেশি ছিল যে তিনি অজ্ঞান হয়ে গেলেন এবং আশেপাশের সাহাবীরা তার জ্ঞান ফিরাতে ব্যাস্ত হয়ে পড়লেন।
উসমান (রা) - যাকে দেখলে ফেরেশতারাও লজ্জা পেতো সেই তিনি যখন কবরের পাশ দিয়ে যেতেন তখন এত কাঁদতেন এত কাঁদতেন যে তাঁর দাঁড়ি ভিজে যেত।
আমাদের রাসুল (সাঃ) - একবার তিনি সাহাবিদের সাথে পথ চলতে চলতে হঠাৎ কেঁদে উঠলেন। সাহাবীরা তাঁকে (সাঃ) জিজ্ঞাসা করলে তিনি বলেন, “আমি আমার ভাইদের জন্য কাঁদছি।” তখন সাহাবীরা তাঁকে (সাঃ) বললেন, “ইয়া রাসুল্লাল্লাহ আমরা কি আপনার ভাই নই?”, তখন রাসুল (সাঃ) বলেছিলেন, “তোমরা তো আমার সঙ্গী, আমার ভাই তো হল তারা যারা আমার পর আসবে এবং আমাকে না দেখেই ভালবাসবে।”
৫.
প্রতিটা জিনিসের নিজস্ব একটা রূপ আছে, তেমনি দুঃখবোধের বাহ্যিক প্রকাশ হল কান্না। আপনি যখন কান্না করেন তখন মনে করা হয় আপনি মানসিকভাবে দুর্বল আর নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন। তাই অনেকেই কান্না ব্যাপারটিকে নিজের মাঝে লুকিয়ে রাখে। কিন্তু এই ধারণাটি একদম সঠিক নয়। তারাই মানসিকভাবে শক্তিশালী যারা তাদের দুঃখের আবেগকে প্রকাশ করতে ভয় পায় না।
আপনি যখন প্রচুর আনন্দে থাকেন তখন কি সুখি চেহারাটা লুকিয়ে রাখেন? যখন উত্তেজিত কোন খবর পান তখন কি মনের উত্তেজনা লুকিয়ে রাখেন? তাহলে কষ্ট পেলে কাঁদবেন না কেন? যারা নিজেরা নিজেদের দুঃখবোধকে লুকিয়ে রাখেন তারা নিজেরাই নিজেদের কে সবচেয়ে বেশি ধোঁকা দেয়। কান্না দুর্বলতার লক্ষণ নয়। আপনি যে মানুষ এবং আপনার যে অনুভূতি আছে তাকেই নির্দেশ করে কান্না। মানুষ যখন চূড়ান্ত আবেগকে মনের মধ্যে লুকিয়ে রাখে তখন সেটা শারীরিক ও মানসিক দুটোর জন্যই ক্ষতিকর। মানুষ যখন কাঁদে তখন চোখের পানির সাথে তার শরীর ও মস্তিষ্ক থেকে স্ট্রেস, উদ্বিগ্নতা, অনুশোচনা ও হতাশা বের হয়ে যায়।
কান্না অন্তরকে পরিষ্কার করে, মনকে সমৃদ্ধ করে এবং স্ট্রেসের ফলে সৃষ্ট নেতিবাচক আবেগকে দূর করতে সাহায্য করে।মজার ব্যাপার হল কান্নার বৈজ্ঞানিক উপকারিতাও আছে। কারণ এর মাধ্যমে বিষাক্ত পদার্থ দূর হয়ে যায় দৃষ্টি শক্তির উন্নতিতে সাহায্য করে [১]।
সাম্প্রতিক এক গবেষণায় দেখা গেছে, কান্না আমাদের মস্তিষ্কের এন্ডরফিনের নিঃসরণকে উদ্দীপিত করতে পারে, যা ভাল অনুভব করার হরমোন এবং প্রাকৃতিক ব্যাথানাশক হিসেবে কাজ করে। কান্নার ফলে ম্যাঙ্গানিজের মাত্রা কমে। ম্যাঙ্গানিজের এর মাত্রা বেশি হয়ে গেলে শরীর ও মন ক্রুদ্ধ হয়ে উঠতে পারে। কান্নার ফলে খারাপ অনুভূতি থেকে মুক্তি পাওয়া যায় এবং সমস্যাটির বিষয়ে পরিষ্কারভাবে চিন্তা করা যায়।
একজন মেয়ে যখন কাঁদে তখন মনে করা হয় সে অস্থির এবং মনোযোগ পাওয়ার জন্য কাঁদছে। একজন ছেলে কাঁদলে মনে করা হয় সে কাপুরুষ, দুর্বল। এজন্যই নারী পুরুষ উভয়ই তাদের দুঃখবোধের আবেগকে মনের গভীরে লুকিয়ে রাখার চেষ্টা করে।
৬.
মাঝে মঝে চিন্তা করি রাসুল (সা) একজন আল্লাহর রাসুল হয়েও সাহাবীদের সামনে কাঁদতে লজ্জা পাননি। তাহলে আমরা কেন পাচ্ছি? যখন নিজের সঙ্গিদের সামনে বা কাছের মানুষের কাছে মনের আবেগকে প্রকাশ করাও একটি সুন্নাহ?
কারণটা নিহিত আছে আমাদের আচরণে, গাছের ঐ পলোতে আর বাচ্চার কাঁদতে গিয়ে বাঁধা প্রাপ্ত হওয়াতে।
Don’t feel shy to cry. Cry if you wanna fly.
১। Marcin A., 2017, ‘9 Ways Crying May Benefit Your Health’; Health Line (Available online: https://www.healthline.com/health/benefits-of-crying#takeaway ) [accessed on 3rd May, 2019]
Sunday, 20 October 2019 at 04:37