এক নববিবাহিত মেয়ের কথা শুনেছিলাম, একটা ছোট্ট শোপিস গুছিয়ে রাখতে গিয়ে ভেঙে ফেলে সে ভয়ে অস্থির হয়ে যায়, ওর স্বামী ওকে এসে কথা শোনাবে। ওর মা সে সময় সামনে ছিল, মেয়ের এই করুণ অবস্থা দেখে খুব কাঁদছিলেন আর বলছিলেন, এত আদরের মেয়েকে অনেক দেখেশুনে সেরা পাত্র, বড় পরিবারে বিয়ে দিলাম—এই তার পরিণতি?

আমার খুব কষ্ট লেগেছিল। সত্যিই ত, সুন্দর চেহারা, দামি জামাকাপড়, পার্টি, ক্যারিয়ার—এ জিনিসগুলি ত এনজয় করা যায় যখন মনের সবটুকু স্বাধীনতা থাকে। একটা জিনিসের মূল্য কতটুকু, ফেললই না হয় ভেঙে, তার বদলে ওর নতুন পরিবার কী করল? তার মনোবলটা গুঁড়ো করে দিল। এরকম কত.. মানুষ দেখলাম, ভুল হলে খুব শক্ত কঠিন ভাষায় শাসন করে। আমি চিন্তা করি, এর পেছনে কারণটা কী? তার কি মনে হয় আত্মসম্মানের গোড়া ধরে টান দিলে সে আর কখনো কথার বাইরে যাবেনা, তখন ইচ্ছেমত এক্সপ্লয়েট করা যাবে? দাসপ্রথা যখন চালু ছিল তখন নাকি দাসদের কাপড় ছাড়া জনসম্মুখে যেতে বাধ্য করত, গোসল করতে দিত না—যাতে করে ওর নিজের ওপরে ঘেন্না চলে আসে। দাসদের কোন স্বাধীন ইচ্ছা বা চিন্তা থাকা খুব বিপদজনক।

আমাদের আধুনিক পরিবারগুলো বুঝে না বুঝে প্রায় একই রকম কাজ করে। শারীরিক আকৃতি নিয়ে মজা করা, কাজে ভুল হলে ‘এতদিনে এই শিখেছ..’ টাইপ কথা বলা, কোন দায়িত্ব দেয়ার প্রস্তাব উঠলে ‘ও পারবেনা’ বলে আগেই ডিসমিস করে দেয়া—এসব দেখে মনে হয় এগুলো মানসিক দাসত্বের বেড়ি ছাড়া আর কিছু না।

আরেকটা কারণ হতে পারে যারা এমন করে তারা নিজেরাও একই ধরণের ব্যবহার পেয়ে এসেছে, আর সময়ের সাথে সাথে কিছুটা অভ্যস্তও হয়ে পড়েছে। নতুন একটা মানুষকে এ ব্যবহার যে কষ্ট দিতে পারে, তা তার মাথায়ও আসেনি। কাজ বা কথা বলার আগে তার পরিণতি নিয়ে আরেকটু বেশি চিন্তা করলে এ সমস্যাটা থাকত না। আল্টিমেটলি এই কথাটা বা ব্যবহারটা যার উদ্দেশ্যে করা, তার সাথে ত সম্পর্ক একটু নষ্টই হবে, তাই না? এই সম্পর্ক কর্মকর্তা কর্মচারি হোক, পরিবারের মধ্যে হোক বা যেখানেই হোক। একটু যে খারাপ ব্যবহার করল তার উদ্দেশ্য কি অন্য মানুষটাকে শোধরানো, না নিজের ভেতরের রাগ ঝাড়া?

অনেক স্মার্ট, আলোকিত মানুষকেই দেখি অন্যের ভুলের ব্যাপারে তাদের মনটা কত কঠোর! একটা ছোট্ট ভুল হলে হেসে উড়িয়েও দেয়া যায়, আবার এর সূত্র ধরে অনেক খোঁটাও দেয়া যায়। কেন যে মানুষ শুধু কর্পোরেট এটিকেই শেখে, মনুষ্যত্ব শেখেনা—বুঝিনা। মনটা অহংকারের বদলে দয়া আর ক্ষমা দিয়ে ভরে দিলে কী হয়? কথা শুনিয়ে মানুষকে আরো বেশি সতর্ক করা যায়, যত্নবান ত করা যায় না। কত বাবা মা ছেলে মেয়ের অবাধ্যতা দেখলে যাচ্ছেতাই গালাগালি করেন, একবার কি চিন্তা করেন, এর এক পার্সেন্টও যদি বুড়ো বয়সে উনাদের কাছে ফিরে আসে তখন কেমন হবে?

মন নরম করার কোন বিকল্প নাই। যে কোন কাজের বা রিলেশনের লং টার্ম বেনিফিট পেতে হলে শক্ত কথা, বিরক্তি—এসব বাদ দিতে হবে। সহানুভূতির সর্বোচ্চ লেভেলে যেতে হবে। অন্য মানুষটা যেন আপনার কথা ভাবলে আপনার আদর, কেয়ারের কথাই ভাবে—এ ব্যাপারে খুব যত্নবান হতে হবে। তা না হলে এইসব শাসন কতটুকু পরিবর্তন আনে জানি না, ঘৃণা আনে অনেক—এটুকু জানি।

ভাবতে খুব অবাক লাগে, প্র্যাক্টিক্যাল প্রবলেমে পড়ে ঠেকে ঠেকে যে সিদ্ধান্তগুলিতে পৌছাই, হাদীস বই খুলে ওগুলোই দেখি সবার আগে লেখা। অন্তরের কাঠিন্য নিয়ে বিলাল ফিলিপস এর এক লেকচারের বাংলা অনুবাদ পেলাম, ওটা পড়তে পড়তে খেয়াল হল, এত এত ফ্যামিলি প্রবলেমের মূল কারণ ত এই কঠিন মন। কেউ কারো দোষ মাফ করেনা, নিজের আরামকে স্যাক্রিফাই করে না, যুক্তিতে ঠিক থাকলে বলে ফেলতে দুইবার চিন্তা করেনা। এগুলি কঠিন মন ছাড়া আর কী? মানুষের আত্মসম্মান কেন এত ঠুনকো হয়ে গেছে, যে অন্যকে ছোট না করে নিজেকে বড় ভাবতে পারেনা? একটু সুবিধা কম হয়ে গেলে তার প্রতিশোধ নিতে ছাড়েনা? আত্মসম্মানের স্ট্যান্ডার্ড-টা যে একজন আরেকজনকে দেখে ঠিক করে, এ কারণেই বোধহয় এরকম। শাশুড়ি বউকে ছোট করে প্রমাণ করতে চায় সংসার চালাতে কে বেশি পারদর্শী। নতুন বউ ঘরে এসেই শাশুড়ির সব বাতিল করে দিতে চায় দেখানোর জন্য যে সে আরো বেশি কোয়ালিফাইড। সম্পর্কের শুরুতে ইনটেনশন এমন না থাকলেও আস্তে আস্তে একটা প্রতিযোগিতা শুরু হয়েই যায়—নিজেকে প্রমাণ করার। এই লড়াই থেকে একজন বের হয়ে আসতে চাইলে যে পরিমাণ হেরে আসতে হয়, সেটা কভার করার মত মনের জোর ত তাকে কেউ দেয়না। তখন আশপাশ থেকে অন্য ভাল কাজ করে মনের জোর জোগাড় করতে হয়। এই ভয়ংকর যুদ্ধের মধ্যে পড়ে কত মন বিকলাঙ্গ হয়ে যাচ্ছে সে খোঁজ কে রাখে?

আল্লাহ, তুমি আমাদের সবাইকে মাফ কর। তোমার দেখানো পথ বেস্ট জেনেও আমরা নিজেরা নিজেদের মত করে পথ খুঁজতে যাই। যারা তোমার পথের সন্ধান পেয়েছে তারা শুধু নিজের আলোটুকু বাঁচাতেই সারা জীবন ব্যস্ত থেকেছে। পথের পাশে এসে একটু দাঁড়ায়নি আমাদের আলোকিত করার জন্য। তুমি আমাদের মাফ কর আল্লাহ, তোমার আলোর মূল্যটাই উপলব্ধি করার মত বোধ আমাদের এখনো আসেনি।


7/12/2011, 6:46:00 PM