[১]
এক. মূসা আলাইহিস সালামের দৃঢ় বিশ্বাস ছিল তিনিই জিতবেন, কেননা আল্লাহ্ তাঁকে বিজয়ের ওয়াদা করেছিলেন। এদিকে সামনে অথৈ সাগর, পেছনে ফিরআউনের সৈন্য, সাথে ভীত ও হতাশ বনী ইসরাঈল। আল্লাহ্ নির্দেশ করলেন লাঠি দিয়ে পানিতে আঘাত করতে, মূসা আদেশ পালন করতেই সমুদ্রের বুকে পথের রচনা হল।
দুই. ইউসুফ আলাইহিস সালামকে যুলায়খা অপকর্মের আহ্বান জানালে তিনি আল্লাহ্র কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করলেন। চারিদিকে তাকিয়ে দেখেন প্রাসাদের সব দরজা বন্ধ, খোলার উপায় নেই। তবু তিনি দৌড়ে গেলেন দরজার কাছে, আল্লাহ্র নির্দেশে দরজা খুলে গেল।
তিন. মারইয়াম বিনতে ইমরান আলাইহিস সালাম প্রসববেদনায় অধীর। খেজুর গাছের নিচে দাঁড়িয়ে পড়লেন। আল্লাহ্ নির্দেশ করলেন গাছ ধরে ঝাঁকাতে, তিনি ঝাঁকালেন আর উৎকৃষ্ট খেজুর পড়তে লাগল।
এরকম অগণিত উদাহরণ দেওয়া সম্ভব। আমি তিনটি বেছে নিয়েছি। এ তিনটি ঘটনার দিকে তাকালে আমরা একটা কমন জিনিস দেখতে পাই। সেটা কী?
লোহিত সাগরের পানির বুকে পথ তৈরি করা আল্লাহ্র জন্য কঠিন কোন কাজ না, এর জন্য মূসার লাঠির আঘাতের দরকার ছিল না। ইউসুফের জন্য দুয়ার খুলে দিতে দরজা পর্যন্ত দৌড়ে যাওয়ার প্রয়োজন ছিল না। কিন্তু ইউসুফ যাওয়ার পরই আল্লাহ্ দরজা খুলে দিলেন। মারইয়ামের জন্য খেজুর ফেলতে গাছকে ঝাঁকানোর কোন দরকার আল্লাহ্র ছিল না। তিনি এমনিই ফেলতে পারতেন। কিন্তু তিনি তা করেন নি। তিনটি ক্ষেত্রেই আল্লাহ্ তাঁর বান্দার পক্ষ থেকে একটা কাজ হবার পর সাহায্য করেছেন।
ঘটনাগুলোর মাধ্যমে আল্লাহ্ মানবজাতিকে একটা মস্তবড় জিনিস শিখিয়ে দিলেন। তা হল এই যে, বান্দা নিজের সামর্থ্য অনুযায়ী চেষ্টা করবে। এরপর আল্লাহ্ আশাতীত উপায়ে সাহায্য করবেন। আপাত অসম্ভব সব ব্যাপারেও প্রথম স্টেপটা বান্দাকেই নিতে হবে।
মূসার দায়িত্ব ছিল লাঠি দিয়ে পানিতে আঘাত করা, পথ সৃষ্টি করার দায়িত্ব আল্লাহ্র। ইউসুফের কাজ ছিল দরজা পর্যন্ত দৌড়ে যাওয়ার, দরজা খোলার দায়িত্ব আল্লাহ্র। দুর্বল ও অসহায় মারইয়ামের দায়িত্ব ছিল প্রচণ্ড শক্ত খেজুর গাছের কাণ্ড ধরে একটা নাড়া দেওয়ার চেষ্টা করা, খেজুর ফেলানোর দায়িত্ব আল্লাহ্র।
নবী আলাইহিমুস সালামদের জীবনী আমরা পড়ি। যেমনি আর দশটা গল্প পড়ি তেমন করে। তাঁদের জীবনকে নিজেদের জীবনের সাথে কানেক্ট করতে পারি না।
‘মুসলিম হয়ে প্রাউড’ কথাটা ফেসবুকের ইনফোতে থেকে যায়, জীবনে আর সত্যিই হয়ে ওঠে না।
আমরা সবাই মানি ইসলাম একটা ব্যালেনসড ধর্ম। কীভাবে ব্যালেনসড? এভাবে যে, ইসলাম অদৃষ্টবাদ আর বস্তুবাদ—দুটোকেই প্রত্যাখ্যান করে। এ দুটো হল দুটো প্রান্তিক বিষয়; অদৃষ্টবাদ সবকিছু ভাগ্যের ওপরে ছেড়ে দিয়ে হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকতে বলে আর বস্তুবাদ বলে ভাগ্য বলতে কিছুই নেই, সবই মানুষের হাতে।
ইসলাম বলছে আল্লাহ্র পক্ষ থেকে যা নির্ধারিত তা হবেই, তবে এই নির্ধারণটা হবে বান্দার প্রচেষ্টা অনুযায়ী। ইখলাস থাকলে বান্দার কোন কাজ আল্লাহ্ বিফল হতে দেন না, হোক তা যতই ছোট। প্রতিদান দুনিয়াতেও দেন, আর না দিলে আখিরাত তো আছেই।
আল্লাহ্র সাহায্য আসার মাধ্যমটা আমাদের বানিয়ে নিতে হবে। মানুষ মনে করে আল্লাহ্র সাহায্য আসবে, এরপর সে কাজ শুরু করবে। অথচ নিয়ম এর উল্টোটাই। আগে কাজ শুরু করতে হবে। এরপর আল্লাহ্র সাহায্য আসা শুরু হবে। কীভাবে আসবে, তা সে ভাবতেও পারবে না।
[২]
ইসলাম মেনে চলার একটা মৌলিক নীতি হচ্ছে ‘শুনলাম ও মানলাম’। আল্লাহ্ ও তাঁর রাসূল যা আদেশ করেছেন আপনি তা নির্দ্বিধায় মেনে নিন, কোন প্রশ্ন না করে। এরপর ফলাফলটা আপনি নিজেই টের পাবেন।
সূরা বাক্বারার ১৫৫ নং আয়াতে আল্লাহ্ মানুষকে কী কী জিনিস দিয়ে পরীক্ষা করবেন, তার একটা সংক্ষিপ্ত তালিকা দিয়েছেন। তালিকার প্রথমেই যেটা উল্লেখ করেছেন তা হল—ভয়। মানুষকে ভয়ের মাধ্যমে পরীক্ষা করা হবে। এই ভয়ের স্বরূপ কী?
ইসলাম মেনে চললে ক্যারিয়ার ধ্বংস হয়ে যাবে—এটা হল ভয়। যাকাত দিলে সম্পদ কমে যাবে—এটা হল ভয়। দাড়ি রাখলে পুলিশ ধরে নিয়ে যাবে/চাকরি পাওয়া যাবে না- এটা হল ভয়। বেশি সন্তান নিলে না খেয়ে মরতে হবে—এটা হল ভয়। বিয়েতে খরচ কম করলে লোকে সমালোচনা করবে—এটা হল ভয়।
শয়তান এই ভয়গুলো তৈরি করে। মানুষের কাজ হল আল্লাহ্র ওপর ভরসা করে দ্বীনের ওপর অটল থাকা, বাকিটা আল্লাহ্র ওপর ছেড়ে দেওয়া। এই লিপ অফ ফেইথটা কয়জন নিতে পারে?
বেশিরভাগ মানুষ সমাজকে প্রভু মানে, আল্লাহকে নয়। সমাজের লোকেরা কী বলল, কে কী মনে করল, এই ভয়ে, চিন্তায় তটস্থ থাকে। অথচ সবাইকে কবরে যেতে হয় একা, সম্পূর্ণ একা। যেদিন ভাই ভাইয়ের শত্রু হবে, মা ছেলেকে চিনবে না, সেদিন সমাজের মানুষ পাপের ভার নেবে না। নিরাপত্তাজনিত কারণে আজকে দাড়ি কাটছি, টাখনুর নিচে প্যান্ট নামাচ্ছি; কবরের নিরাপত্তা কে দেবে ভাই?
আমার বেশভূসা দেখে পরিচিতদের অনেকে বলেন—“তোমাকে নিয়ে চিন্তায় থাকি। যা দিনকাল পড়েছে!” আমার বলতে ইচ্ছা করে—‘আমি আপনাদের নিয়ে এর চেয়েও বেশি চিন্তায় থাকি। আমি দুনিয়া হারালেও অন্তত আখিরাতের আশা করতে পারি, আপনারা কীসের আশা করেন?’
বিপদটা আসলে কোথায়—মানুষ বোঝে না। বোঝার চেষ্টা করে না।
সুদী ব্যাঙ্কের লাখ টাকার চাকরি ছেড়ে দিলে কীভাবে চলব- এটা হল ভয়। এটা হল ধোঁকা। আল্লাহ্র নাম রাজ্জাক, এ কথা বিশ্বাস করতে মন চায় না। আল্লাহ্র ওপর তাওয়াক্কুল আপনাকে আশাতীত উপায়ে রিজিক যোগাবে, মানতে পারেন না? যে পাখিরা খিদে নিয়ে বের হয় আর পেট পুরে নীড়ে ফেরে, তাদের খাবার যোগায় কে? কোন ডিগ্রি? কোন চাকরি? আল্লাহ্ যাকে চান বেহিসেব রিজিক দান করেন। মারইয়ামের খাবার আসত আসমান থেকে। আপনার রিজিক যে আসমানে লেখা, বিশ্বাস করতে পারেন না?
আল্লাহ্ বলেছেন তাঁর দিকে বান্দা এক হাত এগোলে তিনি বান্দার দিকে দুইহাত যান। বান্দা তাঁর দিকে হেঁটে আসলে তিনি বান্দার দিকে দৌড়ে যান। কিন্তু এই একহাত তো যেতে হবে। প্রথম ধাপটা তো উতরাতে হবে। আপনি যদি আল্লাহ্র ওপর ঈমান রেখে তাঁর হুকুম মেনে নেন, গায়েবী সাহায্য কীভাবে আসবে তা কল্পনাও করতে পারবেন না।
[৩]
এককালে গানবাজনার ভক্ত ছিলাম। একদিন সিদ্ধান্ত নিলাম সব ছেড়ে দেব। প্রথমে চিন্তা হচ্ছিল, যে গানের এত ভক্ত, সে মিউজিক ছাড়া কীভাবে থাকবে? ভেবেছিলাম হয়তো কয়দিন পর আবার ফিরে আসতে হবে।
কিন্তু সুবহানআল্লাহ্, আমি গান ছাড়ার দুদিনের মধ্যে আল্লাহ্ আমার অন্তর থেকে গানের আসক্তি তুলে নিলেন। এরপর দেখি কোথাও গান শুনলেই মেজাজ খারাপ হয়। আল্লাহ্ কেন আমাকে সাহায্য করলেন? কারণ আমি প্রথম স্টেপটা নিয়েছিলাম। তা হল কোনকিছু না ভেবে গান শোনা ছেড়ে দেওয়া। বাকিটা আল্লাহ্ করেছিলেন।
এটার নামই লিপ অফ ফেইথ। অনেককে বলতে শুনি হারাম কাজ ছাড়তে চায়, কিন্তু করি করি করেও করতে পারে না। কারণ এই চিন্তা, ছেড়ে দিলে কীভাবে থাকবে? হারাম রিলেশান স্টপ করতে গিয়ে বাধা, গার্লফ্রেন্ডকে ছাড়া কীভাবে থাকবে? শুধু তার কথা মনে পড়বে যে! আরে ভাই, আপনি আল্লাহ্র ওপর ভরসা রেখে ছেড়ে দেন, আপনার অন্তরকে প্রশান্ত করার দায়িত্ব আল্লাহ্র। যে হারামে আসক্তি আছে, তা ছেড়ে দেখুন, আসক্তি দূর করার দায়িত্ব আল্লাহ্কে নিতে দিন।
জুমু’আর দিন আযান হয়ে গেলে আল্লাহ্র নির্দেশ হল বেচাকেনা বন্ধ করে মাসজিদে যাওয়া। আপনার যুক্তি বলবে ঐসময় কজন কোর কাস্টমার আসেন, তাদের ছেড়ে মাসজিদে আসলে ব্যবসায় লস। আপনি আল্লাহ্র নির্দেশ মেনে মাসজিদে আসুন, লাভের দায়িত্বটা আল্লাহ্র ওপর ছেড়ে দিন। ইনশা'আল্লাহ্, যা লস হল তার দশগুণ টাকা আপনার পকেটে এসে যাবে।
ফ্রি মিক্সিং এর আশঙ্কা থাকায় মোটা বেতনের কর্পোরেট জব ছেড়ে সীমিত আয়ের চাকরি নিয়েছেন কত ভাই। আল্লাহ্র কাছে সম্মানিত হবার স্বপ্নে উচ্চ সেক্যুলার ডিগ্রি থাকার পরেও চব্বিশঘণ্টা স্বামীর ঘরের দায়িত্ব নিয়েছেন কত বোন। চারিদিকের কী সমালোচনা, কী তীর্যক মন্তব্য—“এত পড়াশোনা করেছ গৃহিণী হতে!”
এই ভাই-বোনেরা আমাদের আশেপাশেই আছেন। চোখ খোলা রাখলেই দেখা যায়। তাঁদের সংসারে একটা অদ্ভুত প্রশান্তি চোখে পড়ে। কোটিপতিদের মত ঘুমের বড়ি খেয়ে চোখ বুজতে হয় না। শান্তি যে টাকার মধ্যে নেই, এটা বিশ্বাস করতে পারেন? শান্তির যিনি মালিক, তাঁকে সন্তুষ্ট করতে আপনি কাজ করবেন, আর তিনি আপনাকে শান্তি এনে দেবেন না?
নিজের যুক্তির সাথে না মিললেও আল্লাহ্র বিধান মেনে নিয়ে ভালো ফলাফলের বিশ্বাস রাখা—এরই নাম লিপ অব ফেইথ। এই লিপ অব ফেইথটা আমাদের নিতে হবে।
মূসা আলাইহিস সালাম বলেন নি সাগরের বুকে লাঠির আঘাত করে কী লাভ? ইউসুফ আলাইহিস সালাম বলেন নি বন্ধ দরজার দিকে দৌড়ে গিয়ে কী লাভ? মারইয়াম আলাইহিস সালাম বলেন নি দুর্বল শরীরে গাছের প্রচণ্ড শক্ত কাণ্ড নাড়ানোর চেষ্টা করে কী লাভ?
—আমরাও যেন না বলি। আল্লাহ্ তায়ালা তৌফিক দান করুন। আমীন।