আব্দুল ওয়াহেদ ইবনে জায়েদ (র:) বলেন—তিনি একবার আল্লাহর রাস্তায় হিজরত করিয়াছিলেন।
তাহার সাথে এক কিশোরও ছিল। তাঁর বয়স ছিল ১৬। আল্লাহর কালেমা উঁচু করার জন্য তাঁহারা রোম এলাকায় যখন উপস্থিত হন, তখন রোমীয় সৈন্যরা তাঁহাদেরকে বাধা প্রদান করে। শত্রুসেনারা তাহাদেরকে চতুর্দিকে বেষ্টন করিয়া ফেলে।
ঠিক সেই মুহূর্তে উক্ত কিশোর চিৎকার করিয়া বলিতে আরম্ভ করিল, "হায়! আমিতো আয়নার জন্য পাগল হইয়া গিয়াছি, আমি তাহার জন্য অস্থির হইয়া পরিতেছি।"
তাহার এ ধরনের কথা শুনিয়া সবাই বলিতে আরম্ভ করিল, ছেলেটি সম্ভবত পাগল হইয়া গিয়াছে।
অতঃপর সে আব্দুল ওয়াহেদ (র:) এর নিকট হাজির হইয়া বলিল, "হে আব্দুল ওয়াহেদ! আমিতো আয়নার জন্য পাগল হইয়া গিয়াছি।" একথা শুনিয়া আব্দুল ওয়াহেদ (র) বলিলেন, "হে বৎস! তোমার কি হইয়াছে??" ছেলেটি বলিল—
"আমি স্বপ্নে দেখিলাম, এক ব্যক্তি আমার হাত ধরিয়া বলিতেছে, 'চল, আমি তোমাকে আয়নার কাছে নিয়ে যাব।' অতঃপর সে আমার হাত ধরিয়া আয়নার কাছে নিয়া চলিল। কিছু সময় পর আমার একটি পানির নহর দৃষ্টিগোচর হইল। সেই নহরের কিনারায় দাঁড়াইয়া আছে মেয়েরা। তাহাদের পরিধানে এমন সুন্দর পোশাক, যাহা আমি কোনদিন দেখি নাই। তাহাদের রূপ দেখিয়া আমি পাগল হইয়া গেলাম।
সেই মেয়েগুলি আমাকে দেখে বলিল, 'স্বাগতম! স্বাগতম! আয়নার স্বামী আসিয়া গিয়াছে।' আমি প্রশ্ন করিলাম, 'তোমাদের মধ্যে আয়না কে?' তাহারা বলিল, 'আমরাতো আয়নার চাকরানি। আমাদের রাণী রহিয়াছেন আরো আগে। সেখানে গেলেই তাঁকে পাবেন।'
আমি আয়নার অনুসন্ধানে অগ্রসর হইলাম। তথায় দেখিতে পাইলাম, এক দুধের ঝর্ণার পাড়ে দাঁড়াইয়া আছে কতগুলি সুন্দরী, যাহাদের দেখিয়া আমি অভিভূত হয়ে গেলাম। তাহারা আমাকে দেখামাত্র বলিতে আরম্ভ করিল, 'আপনার আগমন শুভ হওক! আয়নার স্বামীর জন্য সুসংবাদ।' আমি বলিলাম, 'প্রথমে বল দেখি আয়না কে?' তাহারা আমাকে জানাইলো, 'আমরাতো আয়নার সেবিকা। আপনি অগ্রসর হউন, আয়নাকে পাবেন।'
আমি ভাবিতে লাগিলাম, আয়নার বাঁদিদের সৌন্দর্য এত বেশি হইলে আয়না কেমন হইবে?? এই কথাগুলি আমার মনে ঘুরপাক খাইতেছিল। আয়নার সাথে আমার দেখা করার আগ্রহ আরো কয়েকগুণ বেড়ে গেল।
আমি আরও অগ্রসর হইলাম। দেখিতে পাইলাম, এক শরাবের ঝর্ণার ধারে দাঁড়াইয়া আছে আরো কতগুলি অনিন্দ্য সুন্দরী যুবতী। তাহাদের রূপ-লাবণ্য দেখে আমি পিছনের সব মেয়েদের কথা ভুলে গেলাম। তাদের সৌন্দর্য সকলকে ছাড়িয়ে গেল। তাহারা আমার আগমনে বলিতে লাগিল, 'আয়নার স্বামীর জন্য সুসংবাদ।' আমি বলিলাম, 'হে আল্লাহর বান্দিগন! আমাকে প্রথমে বল, আমার আয়না কোথায়?' তাহারা জানাইল, 'আমরা আয়নার সেবিকা। আপনি অগ্রসর হউন, তাহাকে পাইবেন।'
আমি অতি উৎসাহে সামনে অগ্রসর হইলাম। একটি মধুর নহর দেখিতে পাইলাম, যাহার কিনারে দাঁড়াইয়া আছে অপরূপ যুবতীগণ। যাহাদের বর্ণনা দেওয়ার মত ভাষা আমার নাই। তাহারা আমাকে দেখা মাত্র বলিতে শুরু করিল, 'মারহাবা! মারহাবা! আয়নার স্বামী আসিয়া গিয়াছে।' এমতাবস্থায় আমার আগ্রহ আরো বেড়ে গেল। আমি তাহাদের নিকট গিয়া বলিলাম, 'হে আল্লাহর বান্দিগণ, আয়না কি আছে?' তাহারা জবাব দিল, 'হাঁ তিনি আছেন, আপনি আগে যান।'
সামনে অগ্রসর হইয়া দেখি একটি তাঁবু। তাঁবুর সামনে দাঁড়াইয়া আছে আপাদমস্তক অলংকার সজ্জিত অপরূপ যুবতীগণ। তাহারা আমাকে দেখামাত্রই তাঁবুর ভিতর গিয়া আয়নাকে খবর দিল, 'হে আয়না! তোমার স্বামী আসিয়া গিয়াছেন।' আমি তাহাদের কথা শুনিয়া আয়নার তাঁবুর দিকে অগ্রসর হইলাম।
তাঁবুর ভিতরে গিয়া দেখি, স্বর্ণ ও ইয়াকুতের মুক্তা জড়ানো পালঙ্কের উপর আয়না হেলান দিয়া বসিয়া আছে।
*এই আয়না সম্পর্কে হাদিসে বলা হইয়াছে—৭০ হাজার চাকরানি থাকবে তাহার ডানে, আর ৭০ হাজার চাকরানি থাকবে তাহার বামে। তাহার পরনে থাকিবে ৭০ জোড়া কাপড়। প্রতি জোড়া কাপড়ের রং হইবে আলাদা। ৭০ প্রকারের সুঘ্রান থাকিবে তাহার শরীরে। মাথায় থাকবে মুকুট। সেই মুকুটে ৭০ টি ইয়াকুত পাথর থাকিবে। একটি ইয়াকুত যদি দুনিয়ায় রাখা হয় তবে গোটা দুনিয়া আলোকিত হয়ে যাবে। তাহার মাথার চুল এত লম্বা থাকিবে যে, চলার সময় পা পর্যন্ত আসে। সেই চুলের একটি চুলও যদি দুনিয়ায় রাখা হয়, তবে গোটা দুনিয়া আলোকিত হয়ে যাবে। তাহার চেহারায় দৃষ্টিপাত করিলে নিজের চেহারা দেখা যাবে।*
তাহার ৭০ জোড়া কাপড় ভেদ করিয়া শরীর দেখা মাত্র ইচ্ছে হল, তাহাকে জড়িয়ে ধরি। ইতিমধ্যে তাহার দিকে অগ্রসর হইলাম, ঠিক সেই মুহূর্তে আয়না আমাকে বলিল, 'মানুষ বড় অধৈর্য। এখন নয়, এখনতো তুমি জীবিত। ভয় পেও না। কিছুক্ষণের মধ্যে তুমি আর আমি একই সাথে নাস্তা করিব'।"
স্বপ্নের বর্ণনা শেষে কিশোরটি বলিল, "হে আব্দুল ওয়াহেদ (রঃ), আমি এর এক মুহূর্তও বাঁচতে চাই না। আমিতো আয়নাকে হাসিল করতে চাই।" অতঃপর রোমীয়দের বিরুদ্ধে এই ছেলেটিই প্রথম আল্লাহর রাস্তায় জান কোরবান করে শহীদ হইয়া গেলো।