কয়েকবছর আগের কথা। তখনও ইসলাম প্র্যাক্টিস শুরু করিনি। ফেসবুকে এক প্র্যাক্টিসিং আপুর প্রোফাইলে দেখি লেখা—A Proud Homemaker. একটু খটকা লাগল। হোমমেকার, মানে গৃহিণীর কাজে আবার প্রাউড ফিল করার কী আছে? এটা কি কোনো যোগ্যতার ব্যাপার?
আলহামদুলিল্লাহ্ দ্বীনকে একটু একটু করে বুঝতে শেখার পর তার সেই প্রাইডের তাৎপর্যটা অনুধাবন করতে পেরেছি। সেই সাথে দেখেছি, দ্বীন মেনে চলা মানুষদেরও অনেকেই আছেন যারা ফেমিনিজমের বলয় থেকে বেরোতে পারেন নি। তারা এখনো মেয়েদের ঘরে থাকাকে প্রাপ্য সম্মানটুকু দিতে পারছেন না। আমার এই লেখাটা মূলত তাদের জন্যই।
১. একটা কথা প্রায়ই কানে আসে। পড়ালেখা করে মেয়েরা কেন গৃহিণী হবে? কেন তাদের যোগ্যতা, মেধার সাক্ষর তারা রাখতে পারবে না? কেন তাদের স্বামীর ঘরে পচে মরতে হবে?
বেগম রোকেয়া থেকে শুরু করে আজকের নারীবাদীরা, সবার মুখের ভাষার মূল একটাই, মেয়েরা বাইরে কাজ করে নিজেদের যোগ্যতা প্রমাণ করতে। একটা মেয়ে যদি ম্যাথ-ফিজিক্স খুব ভালো পারে, তবে তার উচিত সেই মেধাকে ব্যবহার করা, ঘরকন্না নিয়ে পড়ে না থাকা। আমাদের সমাজে মেয়েদের একটা বড় অংশ ডাক্তারি-ইঞ্জিনিয়ারিং-অনার্স পড়ছে, অনেক উচ্চতর ডিগ্রি নিচ্ছে। তারা ছেলেদের সাথে পাল্লা দিচ্ছে, ক্লাসে ফার্স্ট-সেকেন্ড হচ্ছে, জব করছে-এসবের মাধ্যমে তারা নাকি নিজেদের মেধার ব্যবহার করছে।
দ্বীন বুঝতে শেখার আগে কথাগুলো আমার কাছে লজিক্যাল মনে হত। কিন্তু ক্রমে বুঝতে পারে, সেক্যুলাররা আমাদের যা বোঝাতে চায় বাস্তবতা তা নয়। আচ্ছা, আমাদের দেশের গড়পড়তা একটা কর্মজীবী মেয়ে আসলে কী করে? একটা চাকরিই তো! সেখানে সে ‘মেধার প্রয়োগ’ আসলে কতটুকু করে? অফিসে আটঘণ্টা কাজ, বসের ঝাড়ি, তার মনমত চলা—এর মধ্যে আসলে মেধার প্রয়োগ কোথায় হয়? এমন তো না এই মেয়েরা সায়েন্টিস্ট হচ্ছে, গবেষক হচ্ছে। বাংলাদেশের কথা বাদ দিলাম। সারা বিশ্বেরই সায়েন্টিস্টদের মধ্যে কতজন নারী? ইতিহাসের শীর্ষ গণিতজ্ঞ, পদার্থবিজ্ঞানী, রসায়নবিদদের মধ্যে একজন নারী খুঁজে পেতে কেন মাইক্রোস্কোপ লাগে?
কাজেই ম্যাথ-ফিজিক্সে বিরাট প্রতিভাধর নারীরা গৃহপরিচারিকার হাতে সন্তানকে সঁপে দিয়ে যেখানে সীমিত বেতনে নটা-পাঁচটা জব করে ক্লান্ত শরীরে বাড়ি ফেরে, সেখানে তাদের মেধার খুব বেশি অংশ খরচ করতে হয় বলে অন্তত আমার মনে হয় না। এ ত গেল সায়েন্স ব্যাকগ্রাউন্ডের মেয়েরা যারা অন্তত সায়েন্স ফিল্ডেই কাজ করেন তাদের কথা। আমাদের সমাজের বেশিরভাগ কর্মজীবী নারীই অ্যাকাডেমিক ব্যাকগ্রাউন্ডের বেসিসে চাকরি করেন না। ব্যাঙ্কে ঢুকলেই যে এত এত নারী দেখা যায়, তাদের কয়জন ইকোনমিকস ব্যাকগ্রাউন্ডের? আর যারা আছেনও, তাদের কয়জন নিজেদের অ্যাকাডেমিক শিক্ষাকে জব ফিল্ডে কাজে লাগান? এছাড়া বাংলা বা দর্শন থেকে পাশ করা মেয়েরা যে সুদী ব্যাঙ্কে রিসিপ্ট সই করছেন, তাতে মেধার কোন প্রয়োগটা হয়?
সেক্যুলারদের কথা শুনলে মনে হবে নারীরা মেধাবী বলেই তাদের চাকরিতে নেওয়া হয়। অথচ মেয়েদের সবচে বেশি দেখা যায় কর্পোরেট জবগুলোর রিসেপশনে, ফ্রন্ট ডেস্কে, টেলিভিশনের সংবাদ পাঠিকা হিসেবে। এসবে বিবেচ্য কোন ‘মেধা’ নয়, রূপ-কণ্ঠ এবং কে বসের নির্দেশ অনুসারে পোশাক পরতে পারেন তার ওপর। এসব প্রতিষ্ঠানের ভেতরের খবর আমার ভালোই জানা আছে। বিজ্ঞাপনে অপ্রাসঙ্গিকভাবে সুড়সুড়ি দিতে স্বল্পবসনা নারী কোন মেধার বলে চান্স পায়? মোবাইলের অপারেটরে রেকর্ডকৃত নারীর কণ্ঠ কোন মেধার পরিচায়ক? সীমাহীন সংগ্রাম করে ধৈর্য আর বিচক্ষণতার সাথে যে নারীটি তাঁর সংসারকে আগলে রাখেন, তাঁর চেয়ে এই কর্মজীবী মেয়েরা বেশি মেধার প্রয়োগ করে? ব্যাপারগুলো আমাকে ভাবিয়ে তোলে।
২. মেধা মানে কী? মেধা হল আল্লাহ্ প্রদত্ত কতগুলো গুণের কমবাইন্ড রূপ। বোঝার Capability, ধারণক্ষমতা, স্কিল, মেমরি ইত্যাদি অনেকগুলো ব্যাপারকে আমরা একত্রে ‘মেধা’ বলি। এর কোনোটি আল্লাহ্ কাউকে কম দেন, আবার কোনোটি বেশি দেন, সেগুলোকে ব্যবহারের মাধ্যমে বাড়িয়ে নিতে হয়। এই মেধা হল একটা আমানত, যেটা আল্লাহ্ দিয়েছেন এবং আল্লাহর কাছে এই আমানতের হিসাব দিতে হবে। আল্লাহ্ হয়তো কাউকে খুব ভালো মেমরি দিয়েছেন, সেটা সে কোনকাজে ব্যয় করেছে, এর জবাবদিহিতা আল্লাহর কাছে দিতে হবে। সেদিন পড়লাম বিদেশী একজন বোনের কথা যিনি মাত্র আড়াই মাসে কুরআন হিফয করেছেন। সুবহানআল্লাহ্!
আমার যেখানে কয়েকটা আয়াত মুখস্থ করতেই অনেক সময় লেগে যায় সেখানে তিনি আশি দিনেরও কম সময়ে পুরো ত্রিশ পারা হিফয করেছেন। এটা কি মেধার প্রয়োগ নয়? তিনি কি বুয়েট-মেডিকেলে পড়া মেয়েদের চেয়ে কোনো অংশে কম মেধাবী? কিন্তু তিনি তাঁর এই মেধাকে ব্যবহার করলেন এমন একটা কাজে, যা দিয়ে দুনিয়া-আখিরাতে সীমাহীন কল্যাণ হাসিল করা যাবে।
আজকে আইনস্টাইনের থিওরি সলভ করে একটা উচ্চ ডিগ্রি নিয়ে নটা-পাঁচটা জব করা ইঞ্জিনিয়ার মেয়েদের ‘মেধার প্রয়োগ’ দেখে আমরা হাততালি দিই, অথচ এই বোনটার মূল্য দিতে পারি না। শুধু কি চক্ষুহীনেরাই অন্ধ? আমি পড়ি ইঞ্জিনিয়ারিং। ইসলাম নিয়ে একটু একটু করে পড়তে শুরু করার পর থেকে বুঝতে পারি, ইসলামের পড়াশোনাটা ইঞ্জিনিয়ারিং থেকে মোটেই সহজ না, বরং অনেকক্ষেত্রেই বেশি কঠিন। এই পড়ার জন্য মেধা, ধৈর্য, অধ্যবসায়ের অনেক বেশি দরকার আছে।
ইমাম বুখারী-ইমাম তিরমিযী-ইমাম গাজ্জালীদের ফটোগ্রাফিক মেমরি নিয়ে কত কাহিনী প্রচলিত। শাইখ আব্দুল্লাহ আযযাম বলেছিলেন, ইসলামের ফিক্বহ নিয়ে পড়া উচিত সবথেকে মেধাবী ছাত্রদের। দুর্ভাগ্যের বিষয়, এই জায়গাটায় মেধা খাটানোর কথা আমরা ভাবতে পারি না। আমাদের মেয়েরা এত এত মেধাবী বলে আমরা গলা ফাটাই, অথচ ইসলামের বেসিক বিষয়গুলোতে তাদের অজ্ঞতা ছেলেদের চেয়েও বেশি। ইসলাম বিষয়ে মোটামুটি জ্ঞান রাখেন এমন পুরুষ হয়তো অনেকেই আছেন, কিন্তু নারীদের মধ্যে কয়জন কুরআন-সুন্নাহর মিনিমাম প্রয়োজনীয় জ্ঞানটুকু রাখেন? নাহ, জানেন না। কারণ মেয়েরা তাদের মেধার প্রয়োগ ইসলামের ক্ষেত্রে না করে এমন কিছু ক্ষেত্রে করেন, যা আখিরাত তো দূরের কথা, দুনিয়াতেও তাদের বিশেষ কাজে আসে না। এই মেধার কতটুকু মূল্যায়ন করা সম্ভব? শুধু কি সেক্যুলার অ্যাকাডেমিক ডিগ্রি দিয়েই মেয়েরা খুব উচ্চশিক্ষিত হচ্ছে বলে সিদ্ধান্তে আসা যায়?
৩. এবার একটু তুলনামূলক আলোচনা করি। আমাদের সমাজের একজন গড়পড়তা তরুণী মেয়ের দিনের একটা বড় অংশ কাটে বিভিন্ন ভঙ্গিতে ছবি তুলতে, সে ছবি আপলোড দেওয়া এবং ছবি তোলার জন্য নিজেকে প্রস্তুত করতে করতে। দিনের বাকি অংশ কাটে গালগল্প করতে করতে, কে কী পরল, কার কতটুকু ম্যাচিং হয়নি সে হিসেব করতে করতে। এছাড়া ভারতীয়-ইংরেজি সিরিয়াল আর মুভি এসব তো আছেই। আর বয়ফ্রেন্ড থাকলে তো কথাই নেই। দেশের শীর্ষস্থানীয় ভার্সিটিগুলোর শীর্ষ মেয়েরা, যাদের আমরা খুব ‘মেধাবী’ বলে জানি, তাদেরও বেশিরভাগ সময় এভাবেই কাটে। এসব কোন ‘মেধা’র পরিচায়ক, আমার জানা নেই। বিয়ের পরেও এই রুটিনে খুব বেশি পরিবর্তন আসে না। হ্যাঁ, জব করতে গিয়ে হয়তো বিনোদনের সময়টা একটু কম পান। তবে ভারতীয় সিরিয়াল আর পাশের বাড়ির ভাবীর সাথে অমুক ভাবীর আলোচনা করে ভালোই টাইম পাসিং হয়। দুজন নারী কথা বলবে আর তৃতীয় কাউকে নিয়ে আলাপ হবে না এ যেন ভাবাই যায় না, তাই না!
আর সংসারের সমস্যাগুলোকে হতাশা বাড়ানোর উপকরণ হিসেবে দেখা হবে, কেন অমুক ভাবী এত দামী শাড়ি পরেন আর আমি এত কমদামি শাড়ি পরি, এই আক্ষেপে জীবনের অর্ধেক আনন্দ মাটি হবে। অন্যদিকে একজন বিবাহিতা প্র্যাক্টিসিং মুসলিমাহ গৃহিণী নারীর কথা ধরুন। তিনি ইসলাম স্টাডি করেন যথাসাধ্য, ইসলামের সূক্ষ্ম বিষয়গুলো নিয়ে গবেষণা করেন, তার প্রয়োগ করেন, স্বামী-সংসারের দেখভালে নিয়মিত কুরআন-সুন্নাহর হেল্প নেন, সংসারের সমস্যাগুলো ইসলামের জ্ঞান দিয়ে সমাধান করেন, স্বামীকে প্রেরণা দেন, পরামর্শ দেন, সংসার সামলাতে প্রচুর ধৈর্য আর বিচক্ষণতার পরিচয় দেন। প্রেরণা গ্রহণ করেন ইসলামের ইতিহাসের আলোকিত নারীদের কাছ থেকে। পাশের বাড়ির ভাবীর সাথে আলোচনার বিষয় হয় শাইখ উসাইমিনের অমুক বইটা পড়েছেন কি না, আর কুরআন কার কতটুকু মুখস্থ হল তার আপডেট। এখন বলুন তো, এই দুই শ্রেণীর নারীর মধ্যে কে বেশি মেধাবী? কে বেশি 'মেধার প্রয়োগ' রাখেন?
বাঁদরের ভঙ্গিতে সেলফি তোলা মেয়েটির হয়তো হায়ার ডিগ্রি আছে, জব করে। আর ‘ঘরে আটকে থাকা’ মেয়েটির এত ডিগ্রিও নেই, জবও করে না। অথচ তাদের দৈনন্দিন কাজগুলো আমাদের বলে দেয়, কে মস্তিষ্ক ব্যবহার করে আর কে করে না। হ্যাঁ, এটাকেই আমরা মেধার প্রয়োগ বলি। আমাদের হোমমেকার নারীরা তোমাদের কর্পোরেট মেয়েদের চেয়ে শতগুণ বেশি মেধাবী আলহামদুলিল্লাহ্।
৪. শিক্ষাব্যবস্থার সেক্যুলারকরণের সাথে সাথে মেয়েদেরকে পুরুষের ‘সমান’ বানাবার এক অস্বাভাবিক প্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ করার একটা ধরণ হল এই, ছেলেদের এবং মেয়েদের একই সাবজেক্টে একই মেথডে একই জায়গায় একইসাথে পড়াশোনা করতে হবে, এরপর জব ফিল্ডে তাদের একইভাবে নেওয়া হবে। অথচ বিয়ের ক্ষেত্রে সবসময় চাওয়া হবে ছেলের পজিশন যেন মেয়ের ওপরে থাকে। বাংলাদেশে আজ লাখ টাকা বেতনের চাকরি করা মেয়ে কয়জন? কিন্তু দেখা যায় স্বল্প বেতনের মেয়েটিও লাখ টাকার ছেলে খোঁজে বিয়ের জন্য। মেয়েটি কোন উপার্জন না করলেও উচ্চ পদের ছেলের সাথে তার বিয়ে হয়ে যায়, কিন্তু ছেলেটির উপার্জন না থাকলে তার বিয়ে হবে না বছরের পর বছর চলে গেলেও। আসলে মানুষকে একটা পর্যায়ে গিয়ে ফিতরাহের কাছে আত্মসমর্পণ করতেই হয়। বিয়ের পর ছেলেটিই মেয়েটির দায়িত্ব নেবে, তাকেই সংসার চালাতে হবে; এসব মানুষ পাল্টাতে পারে না, কারণ তবে সমাজের ভিত্তিই নড়ে উঠবে। অথচ এই পর্যায়টির কথা ভেবে আগের স্টেজগুলো গড়ে ওঠানো হয় না, সবখানে জোর করে নারী-পুরষকে ‘সমান’ বানানোর চেষ্টা, শেষে গিয়ে খাপ না খাওয়াতে পেরে ব্যালেন্স নষ্ট করা। আল্লাহ্ নারী-পুরুষকে আলাদা করে বানিয়েছেন, সমাজে আলাদা ভূমিকা দিয়েছেন। এই পৃথক ভূমিকার জন্য প্রত্যেক ছেলে এবং মেয়েকে গড়ে তোলাটাই যৌক্তিক ছিল।
কিন্তু ‘ছেলেদের যা পড়তে হবে মেয়েদেরও ঠিক তাই তাই পড়তে হবে’—এমন একটা জবরদস্তিমূলক মানসিকতা নারীদের সেই ‘নারীত্ব’কে বিনষ্ট করে দিতে চায়, ফলাফল সংসারজীবনে গিয়ে ভাঙ্গনের উপক্রম। এক সেক্যুলারপন্থী আপুর একটা লেখায় পড়েছিলাম এক মেয়ে বিয়ের পর অফিস থেকে রাত এগারোটায় বাড়ি ফিরে দেখে তার স্বামী না খেয়ে বসে আছে, কারণ স্বামী রান্না করতে জানে না আর মেয়েটিও রান্না করে যায় নি। এটা নিয়ে মনোমালিন্য দেখা যায়। লেখিকা আপু পুরো দোষ চাপিয়ে দিয়েছেন স্বামীর ওপরে, সে কেন রান্না করতে পারবে না? অথচ মেয়েটি কেন স্বামীকে একলা ঘরে রেখে রাত এগারোটা পর্যন্ত বাইরে থাকবে, এই প্রশ্নটা তাদের ওঠে না, কারণ তারা বিশ্বাস করে একটা মেয়ে যত বেশি বাড়ির বাইরে থাকবে তত সে ‘মেধাবী’, স্বামী-সন্তানের ‘বন্দীশালা’ থেকে মুক্ত হয়ে সে তত স্বাধীন!
অথচ এই মেয়েরা যে মস্তিষ্কের ওপর একটা দাসত্বের শৃঙ্খলে বন্দী হয়ে আছে সেটা তারা বোঝে না, সেক্যুলাররা তাদের যেভাবে ভাবাতে চায় তারা ঠিক সেভাবেই ভাবে। এটাই মানসিক দাসত্ব, যা শারীরিক দাসত্বের চেয়ে অনেক বেশি বিপদজনক। ‘মেধার প্রয়োগ’ ঘটানোর কথা বলে তারা আমাদের মেয়েদের দাস বানাতে চায়, আর আমরা মৌলবাদীরা তাদের চাহিদার মুখে পদাঘাত করি। এইজন্য আমাদের প্রতি তাদের এত রাগ।
৫. একটা মেয়েকে বিয়ের পর অনেকগুলো কঠিন ধাপ অতিক্রম করতে হয়। নতুন পরিবেশে নতুন মানুষদের সাথে খাপ খাইয়ে নেওয়া, দ্রুত ম্যাচিউর হবার তাড়না; আর যদি চারপাশের লোকেরা হেল্পফুল না হয় তবে তো কথাই নেই। এরপর সন্তান ধারণ, প্রতিপালন, কনডাক্ট এসব তো আছেই। এসবগুলো কাজ সাফল্যের সাথে করতে গেলে নিজের মেধার সর্বোচ্চ প্রয়োগ ঘটানোর কোন বিকল্প নেই। সীমাহীন, ধৈর্য, অধ্যবসায়, বিচক্ষণতা, ত্যাগ, আত্মনিয়ন্ত্রণ আর অন্যান্য মানবিক গুণাবলির সমাহার প্রয়োজন। মায়েদের মর্যাদার কথা কেন এতবার আসে সেটা আমি নিজের মায়ের কথা ভাবলে বুঝি। তিনিও গৃহিণী। তাঁকে দেখে বুঝেছি আদতে সংসার সামলানোর এই কাজটা কত কঠিন।
আশ্চর্য এই যে, নারীবাদীদের চোখে সংসার করা নাকি মেধার অপব্যয়! গৃহিণী নারীরা নাকি কাজ না করে ঘরে বসে থাকেন!! এই মেন্টালিটির রেজাল্টটা আমরা খুব সহজেই পেতে বসেছি। আজকে ঘরে ঘরে একেকটা ফ্র্যাঙ্কেস্টাইন গড়ে উঠছে। যারা নিজের বাপকে কুপিয়ে মারে, মাকে গুলি করে। বিপথগামী ছেলেমেয়ের দিকে তাকিয়ে বাবা-মা রা কপাল চাপড়ায়—কেন সময় থাকতে প্যারেন্টিং কে গুরুত্ব দেই নি। প্যারেন্টিং কাজটা খুবই কঠিন। একটা সন্তানকে আল্লাহর অনুগত বান্দারূপে গড়ে তোলা বড় শক্ত কাজ। ক্ষণিকের একটা ভুল সিদ্ধান্তের মাসুল দিতে হয় আজীবন। অথচ আমাদের বলা হচ্ছে, এই কাজটিতে নাকি মেধার প্রয়োগ নেই!! মেধার প্রয়োগ কেবল ভারী ভারী বই গলধঃকরণে!! জাফর ইকবাল ম্যাথ অলিম্পিয়াডে মেয়েদের অংশগ্রহণকে মেধার মাপকাঠি মাপে। আমরা তা মানি না। একজন মেধাবী নারী মানে একজন সফল স্ত্রী। একজন মেধাবী নারী মানে একজন সফল মা। আর আজকের সেক্যুলার শিক্ষায় ফার্স্ট-সেকেন্ড হওয়া ‘মেধাবী’ মেয়েরা স্ত্রী-মায়ের ভূমিকায় একের পর এক ব্যর্থ হলেও তাদের গুণগানে মুখরিত নারীবাদী সমাজ! কারণ তাদের দিয়ে নিজেদের স্বার্থ হাসিল যে বড্ড সহজ!
শেষ কথাঃ গৃহিণী মুসলিম নারীদের প্রতি সেক্যুলারদের খুব রাগ। শিক্ষাব্যবস্থা থেকে শুরু করে জব ফিল্ডের ব্যাকগ্রাউন্ড প্রস্তুত-সম্ভবপর সবকিছুই তারা করল মেয়েদের হাতের পুতুল বানাতে। অথচ এরপরও কিছু পর্বতহৃদয় নারী তাদের দেখানো চাকচিক্যের তোয়াক্কা না করে আল্লাহর সন্তুষ্টির আশায় স্বামী-সন্তানের প্রতি দায়িত্ব পালনের সর্বোচ্চ চেষ্টা করেন।
এই মেয়েরা তৈরি করেন একেকজন সিংহপুরুষ। নুসাইবাদের ঘরেই হাবীব বিন জায়েদদের জন্ম হয়। পার্থিব অর্জনের সীমাহীন মোহের জাল বিছিয়ে এই মুত্তাকী নারীদের কিনতে পারে না বলেই 'ঘরে আটকে থাকা', 'মেধার অপচয়'সহ হাজাররকম কুৎসা আর নিন্দার ঝড়। এর মূলে তাদের গায়ের জ্বালা। ক্ষোভ। হিংসে। হ্যাঁ, আমাদের মেয়েরা 'ঘরে আটকে থেকে'ই পৃথিবী জয় করবে ইনশা আল্লাহ্। আমাদের মায়েদের গড়ে তোলা সিংহরাই জমিনের বুকে আবার কালিমার পতাকা উত্তোলন করবে বিইযনিল্লাহ।
ডিয়ার সেক্যুলার নারীবাদীরা,
"তোমরা তোমাদের আক্রোশে মরতে থাকো" [সূরা আল ইমরান:১১৯]
এবং সবশেষে, মুসলিম নারীদের জন্য আবার সেই স্মরণিকা-
“যখন নারী তার পাঁচ ওয়াক্তের সালাত আদায় করবে, তার (রমযান) মাসের সাওম পালন করবে, তার লজ্জাস্থানের হেফাজত করবে এবং তার স্বামীর আনুগত্য করবে, তখন তাকে বলা হবে: তুমি জান্নাতের যে দরজা দিয়ে ইচ্ছা কর, সে দরজা দিয়ে জান্নাতে প্রবেশ কর।” [১৬৬১- মুসনাদে আহমাদ]