১৮৩৫ সালে ভারতের অমৃতসারের কাদিয়ানে জন্ম হয় মির্যা গোলাম কাদিয়ানির। এ লোক প্রথমে দাবি করে সে ইসলামের একজন মুজাদ্দিদ (সংস্কারক), তারপর দাবি করে সে আল-মাহদী এবং তারপর দাবি করে সে প্রতিশ্রুত মসীহ। শেষমেশ দাবি করে বসে তার কাছে ওহী আসে, সে আল্লাহর প্রেরিত নবী। তবে সে নতুন কোনো শরীয়াহ আনেনি, হারুন আলাইহিস সালাম যেমন মুসা আলাইহিস সালামের অনুগামী নবী ছিলেন তেমনি সেও খাতামুন নাবিয়্যিন মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের শরীয়াহর অনুগামী নবী। মির্যা গোলামের অনুসারীরা কাদিয়ানি হিসেবে পরিচিত, যদিও তারা নিজেদের ‘আহমাদি’ বলে দাবি করে।
শুরু থেকেই সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশরা নানাভাবে কাদিয়ানিদের সাহায্য এবং পৃষ্ঠপোষকতা করে। মির্যা গোলাম এক অর্থে ছিল ব্রিটিশদের এজেন্ট এবং তার উত্থানের পেছনে ছিল ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদীদের সক্রিয় ভূমিকা। পরবর্তীকালে এ লিস্টে যুক্ত হয়েছে অ্যামেরিকাও। আজও কাদিয়ানিদের মূল হেডকোয়ার্টার লন্ডনে। বিস্ময়কর ব্যাপার হলো, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে শেষ নবী হিসেবে প্রত্যাখ্যান করা এবং মির্যা গোলামকে নবী মনে করা কাফির কাদিয়ানিরা নিজেদের মুসলিম দাবি করতে চায়। আরও অবাক করা ব্যাপার হচ্ছে সারা দুনিয়াজুড়ে ইসলামের বিরোধিতা ও মুসলিমের অধিকার হরণে ব্যস্ত যায়নিস্ট-ক্রুসেইডাররা কাদিয়ানিদের ‘মুসলিম হবার অধিকার’ নিয়ে খুব উদ্বিগ্ন! কাদিয়ানিদের পক্ষে নিয়মিত লবিয়িং করা হয় ব্রিটেন-অ্যামেরিকা থেকে।
একেবারে শুরু থেকেই কাদিয়ানিদের বিরোধিতা করে আসছেন উপমহাদেশের আলিমগণ। বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন ব্যানারে কাদিয়ানি-বিরোধী আন্দোলন করেছেন বাংলাদেশের আলিমরাও। কিছুদিন আগেও ২০১৯ এর ফেব্রুয়ারিতে কাদিয়ানিরা পঞ্চগড়ে ‘জলসা’ এবং ‘মহাসমাবেশ’ করার উদ্যোগ নিলে এর তীব্র বিরোধিতা করে বাংলাদেশের আলিমগণ আবারও কাদিয়ানিদের বিরুদ্ধে আন্দোলনের কথা বলেন। দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা এ আন্দোলনের মূল দাবি হলো, রাষ্ট্রীয়ভাবে কাদিয়ানিদের কাফির ঘোষণা করা, তাদের প্রকাশনা ও প্রচারণা নিষিদ্ধ করা, কাদিয়ানিদের জন্য ইসলামী পরিভাষা ব্যবহার নিষিদ্ধ করা (যেমন : কাদিয়ানিদের উপাসনার জায়গাকে ‘মসজিদ’ না বলে ‘উপাসনালয়’ বলা)। ২০১৩ তে প্রকাশিত হেফাজতে ইসলামের ১৩ দফার ৬ নম্বর দাবিটিও ছিল কাদিয়ানিদের নিয়ে। এ দাবিতে বলা হয়,
‘সরকারিভাবে কাদিয়ানিদের অমুসলিম ঘোষণা এবং তাদের প্রচারণা ও ষড়যন্ত্রমূলক সব অপতৎপরতা বন্ধ করা।’
বাংলাদেশের ধর্মনিরপেক্ষ এবং সুশীলদের তরফ থেকে বিভিন্ন সময়ে আলিমদের এ দাবিগুলোর সমালোচনা ও বিরোধিতা করা হয়েছে। তাদের বক্তব্য হলো, কাদিয়ানিরা যদি নিজেদের মুসলিম মনে করে, তাহলে তাদের আত্মপরিচয় পরিবর্তন করার অধিকার রাষ্ট্রের নেই। এটি সরাসরি মানুষের মৌলিক অধিকারের পরিপন্থী এবং বাংলাদেশে সংবিধানের ঘোষিত ধর্মনিরপেক্ষতার মূলনীতির সাথে সাংঘর্ষিক। সংবিধান প্রত্যেক নাগরিককে সমান ও স্বাধীনভাবে নিজের পছন্দমতো ধর্ম পালন ও প্রচারের স্বাধীনতা দেয়। নিজস্ব ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার অধিকার আছে প্রত্যেক ধর্মের অনুসারীদের। কাজেই এ ধরনের দাবি প্রথমত নির্যাতনমূলক, দ্বিতীয়ত অসাংবিধানিক।
ইসলামের অবস্থান থেকে কাদিয়ানিদের কাফির হবার ব্যাপারে বিন্দুমাত্র সন্দেহ না থাকলেও সেক্যুলার রাষ্ট্র এবং সংবিধানের জায়গা থেকে কাদিয়ানিদের পক্ষাবলম্বনকারীদের কথাগুলো উড়িয়ে দেয়া যায় না। কে মুসলিম আর কে মুসলিম না সেটা কি রাষ্ট্র ঠিক করবে? রাষ্ট্রের কি অধিকার আছে তাকফির করার? কোনো গোষ্ঠী বা সম্প্রদায়ের দাবি ও ধর্মীয় বিশ্বাসের বৈধতা যাচাই করার এখতিয়ার কি রাষ্ট্রের আছে? রাষ্ট্র যদি কাদিয়ানিদের কাফির ঘোষণা করার সিদ্ধান্ত নিতে পারে, তাহলে কি সেটা–তাত্ত্বিকভাবে হলেও–অন্যদের ক্ষেত্রে প্রয়োগযোগ্য হবে না?
অন্যদিকে ইসলামের দৃষ্টিকোণ থেকে কাদিয়ানিদের মুসলিম হিসেবে মেনে নেয়া একেবারেই অসম্ভব। কাদিয়ানিদের জন্য যেটা ধর্মীয় স্বাধীনতা মুসলিমদের জন্য সেটা জঘন্য ধর্মদ্রোহিতা। কাদিয়ানিদের তাদের সাংবিধানিকভাবে সংরক্ষিত অধিকার দেয়ার মাধ্যমে রাষ্ট্র যদি তাদের মুসলিম হিসেবে মেনে নেয়, তাহলে রাষ্ট্র এ ক্ষেত্রে সরাসরি কুরআন ও সুন্নাহর বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে, এ যুক্তি কিন্তু কেউ দিলেও দিতে পারে। রাষ্ট্র এখানে যার পক্ষই নিক না কেন, সেটা হবে কারও না কারও ধর্মীয় স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ।
যতই ‘ধর্ম যার যার উৎসব সবার’ বলা হোক না কেন, একটা সেক্যুলার রাষ্ট্রে সত্যিকার অর্থে ধর্মীয় স্বাধীনতা থাকতে পারে না। সেক্যুলারিযম যা দিতে পারে তা হলো সেক্যুলার সংবিধানের অধীনে, সেক্যুলারিযমের সীমার ভেতরে থেকে কিছু নির্দিষ্ট বিশ্বাস, কথা ও কাজের স্বাধীনতা। ব্যাফোমেট কিংবা কাদিয়ানিদের নিয়ে ঘটনাগুলো চোখে আঙুল দিয়ে এ সত্যটা আমাদের দেখিয়ে দেয়।